রেনেসাঁ সংক্রান্ত বিতর্ক সম্পর্কে লেখো
অথবা, নবজাগরণ কি এক নতুন যুগের সূচনা করে? তোমার উত্তরের সপক্ষে যুক্তি দাও
রেনেসাঁ সংক্রান্ত বিতর্ক
রেনেসাঁ বা নবজাগরণ বলতে বোঝায়, নবজন্ম বা নবজীবন লাভ। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ইটালি তথা ইউরোপে মননশীল পরিবর্তনের ঘটনাকে ব্যাপকতর অর্থে নবজাগরণ বলা যায় কি না এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে।
(1) রেনেসাঁর সপক্ষে যুক্তি: কিছু পণ্ডিত মনে করেন যে, পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন, ধ্রুপদি সংস্কৃতির বিলোপ, সামন্ততন্ত্রের আবির্ভাব, কঠোর খ্রিস্টীয় অনুশাসন সমাজ ও সভ্যতাকে গভীর সংকটে নিক্ষেপ করেছিল। পঞ্চদশ শতকে মননশীল চর্চার সূত্রে সেই সংকটের অবসান ঘটে এবং ধ্রুপদি সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ হয়। এরই সঙ্গে উচ্চারিত হয় মানুষ ও জীবন, সমাজ সম্পর্কে নানা অধিকারের কথা। মননশীলতার এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনকে নবজাগরণ আখ্যায় ভূষিত করা এঁরা সঠিক বলে মনে করেন।
- রেনেসাঁ যুগের মানবতাবাদীদের চিন্তাধারা: রেনেসাঁ যুগের মানবতাবাদীরা তাঁদের সময়কালকে Age of Light বা আলোকের যুগ বলে মনে করতেন। নবজাগরণের প্রথমদিককার বিশিষ্ট কবি পেত্রার্ক এই পর্বকে মানুষের অন্ধকারের দ্বার ভেঙে পবিত্র আলোয় আসার পর্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একই মত প্রকাশ করেছেন গিয়োত্তো এবং বোকাচ্চিও-এর মতো ব্যক্তিত্বরাও।
- জ্যাকব বুখার্ডের অভিমত: ঐতিহাসিক জ্যাকব বুর্খার্ড তাঁর The Civilization of the Renaissance in Italy গ্রন্থে বলেছেন নবজাগরণ ও মানবতাবাদ হল অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগের অবসান (পঞ্চম-চতুর্দশ শতক) ও আলোকোজ্জ্বল আধুনিক যুগের সূচনা।
(2) রেনেসার বিপক্ষে যুক্তি: অপরদিকে একদল পণ্ডিত ১৯৪০-এর দশক থেকে এই নবজাগরণ তত্ত্বের সমালোচনা শুরু করেন। এঁরা মনে করেন, ক্যারোলিঞ্জীয় আমল (নবম শতক) এবং তার পরবর্তীতে, অর্থাৎ দ্বাদশ শতকে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস ও প্রাকৃতিক ধ্যানধারণার প্রসঙ্গে সমকালীন চিন্তাবিদগণ যুক্তিসম্মত নতুন ভাবনার প্রচার করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে ব্যাপক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিরোধিতার ফলে এই ধ্যানধারণা চূড়ান্ত রূপ নিতে পারেনি। এরপর পঞ্চদশ শতকে মানবতাবাদী পণ্ডিতেরা নবম ও দ্বাদশ শতকের অসম্পূর্ণ কাজগুলি সম্পূর্ণ করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। তাই পঞ্চদশ শতকের পরিবর্তনকে সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার কোনও বিচ্ছিন্ন বা অভূতপূর্ব রূপান্তর বলা যায় না।
- হ্যাস্কিন্স-এর অভিমত: চার্লস হোমার হ্যাস্কিন্স তাঁর The Renaissance of the Twelfth Century গ্রন্থে বলেছেন যে, পঞ্চদশ শতকেরও পূর্বে দ্বাদশ শতক নাগাদ বিভিন্ন ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্রুপদি সাহিত্য ও দর্শনপাঠে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল।
- ক্রিস্টেলার-এর অভিমত: পল ক্রিস্টেলার-এর মতে, পঞ্চদশ শতকের আগেই ইসলামের সম্প্রসারণ, মোঙ্গল উপজাতির অভিযান প্রভৃতির দরুন ইউরোপের সঙ্গে এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার যোগাযোগ ঘটে যায়। ফলত আরব বণিকদের মাধ্যমে প্রাচীন গ্রিক পুথির সঙ্গে ইউরোপের পরিচয় ঘটে। তাই গ্রিকো-রোমান সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার পঞ্চদশ শতকের নবজাগরণের একমাত্র উপাদান হতে পারে না।
- অন্যান্য মত: কারও কারও মতে, আধুনিক যুগের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানচর্চাকে রেনেসাঁ যুগের মানবতাবাদীরা অবহেলা করেছিলেন। আবার যেহেতু এই যুগে বড়ো কোনও যন্ত্রপাতির আবিষ্কার হয়নি, তাই অনেকে বলেছেন যে এই পর্বে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নবজাগরণ হয়নি।
মূল্যায়ন
তবে বিতর্ক সত্ত্বেও এটা অস্বীকার করা যায় না যে, ইউরোপীয় রেনেসাঁ নিঃসন্দেহে আধুনিকতার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে ইটালিতে যে আধুনিকতার সূচনা হয়েছিল, পঞ্চদশ শতকে সেই লক্ষণগুলিই আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর