রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর (Marks 4) একাদশ শ্রেণি | ইতিহাস প্রথম অধ্যায় Second Semester

সূচিপত্র

রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর (Marks 4) একাদশ শ্রেণি | ইতিহাস প্রথম অধ্যায় Second Semester

রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর
রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর

১। কৌটিল্য বা চাণক্যের পরিচয় দাও।

কৌটিল্য বা চাণক্যের পরিচয়

প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে একটি সুপরিচিত নাম হল কৌটিল্য, তিনি চাণক্য বা বিষুগুপ্ত নামেও পরিচিত। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে সর্বপ্রথম রাষ্ট্র সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করেন।

(i) প্রথম জীবন: কৌটিল্য ছিলেন মৌর্য যুগের একজন কূটনীতিপরায়ণ ব্রাহ্মণ। তাঁর জন্ম বা ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকেই মনে করেন যে, আনুমানিক ৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ (মতান্তরে ৩৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নাগাদ তাঁর জন্ম হয়। * জানা যায়, প্রথম জীবনে তিনি তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন।

(ii) নন্দ বংশের উচ্ছেদসাধন: শোনা যায়, একবার নন্দ বংশের শেষ রাজা ধননন্দের দরবারে অপমানিত হয়ে কৌটিল্য এই বংশের উচ্ছেদসাধনের প্রতিজ্ঞা করেন। এই সময় তাঁর সাক্ষাৎ হয় চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে। তিনি বালক চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে রাজোচিত লক্ষণ দেখে তাঁকে তক্ষশিলায় নিয়ে যান এবং যুদ্ধবিদ্যা ও রাজনীতিতে পারদর্শী করে তোলেন। শেষপর্যন্ত ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দ্বারা মগধে নন্দবংশের উচ্ছেদ ঘটিয়ে কৌটিল্য মৌর্য বংশ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন। অতঃপর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে কৌটিল্য তাঁর প্রধানমন্ত্রী ও পরামর্শদাতারূপে নিযুক্ত হন।

(iii) অর্থশাস্ত্র রচনা: কৌটিল্য সম্পর্কে সম্যক ধারণালাভের জন্য তাঁর রচিত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটির প্রসঙ্গ উল্লেখ অবশ্যপ্রয়োজনীয়। মহীশূরের পণ্ডিত ড. আর শ্যামশাস্ত্রী ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি আবিষ্কার করেন। অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা কে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশ পণ্ডিতগণ কৌটিল্যকেই অর্থশাস্ত্রের রচনাকার হিসেবে মেনে নিয়েছেন। এই গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু হল- রাষ্ট্রনীতি। তদুপরি রাজার কর্তব্য, রাষ্ট্রের প্রকৃতি, যুদ্ধনীতি, প্রজাকল্যাণ ইত্যাদি নানা বিষয়ে তাঁর অভিমত ও পরামর্শ এতে লিপিবদ্ধ আছে।

আনুমানিক ২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই প্রখ্যাত কূটনীতিবিদ মৃত্যুবরণ করেন। প্রবল রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও অসামান্য কূটনৈতিক জ্ঞানের জন্য কৌটিল্য ভারতের ম্যাকিয়াভেলি নামে পরিচিত হন।

২। কৌটিল্যকে ‘ভারতের ম্যাকিয়াভেলি’ বলা হয় কেন?

কৌটিল্যকে ‘ভারতের ম্যাকিয়াভেলি’ বলার কারণ

প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে কৌটিল্য বা চাণক্য একটি অতি পরিচিত নাম। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী তথা মুখ্য উপদেষ্টা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি প্রাচীন ভারতের রাজনীতিচর্চার একটি অন্যতম নিদর্শনরূপে পরিগণিত হয়। অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে উল্লিখিত রাষ্ট্রতত্ত্বের নিরিখে বহু চিন্তাবিদ ও ঐতিহাসিকই কৌটিল্যকে ‘ভারতের ম্যাকিয়াভেলি’ -এই অভিধায় ভূষিত করেছেন। নবজাগরণের সন্তান এবং বিখ্যাত The Prince গ্রন্থের রচয়িতা নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি পাশ্চাত্য রাষ্ট্রচিন্তার জগতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। রাষ্ট্রচিন্তা সংক্রান্ত নানা বিষয়ে উভয়ের আলোচনায় যেসকল সাদৃশ্য মেলে, তার ভিত্তিতে কৌটিল্যকে ভারতের ম্যাকিয়াভেলি বলা যেতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন।

(i) রাজার কর্তব্য বিষয়ে মত: কৌটিল্য ও ম্যাকিয়াভেলি উভয়েই তাঁদের গ্রন্থে রাজার শাসন পরিচালনা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার সঙ্গে রাজ্যের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং সেই অনুসারে রাজার কর্তব্য সম্পর্কেও বর্ণনা দিয়েছেন।

(ii) রাজার ক্ষমতা সম্পর্কে মত: কৌটিল্য যেমন রাজার প্রধান লক্ষ্য হিসেবে অনায়ত্ত এলাকা অর্জন ও তার সুরক্ষা প্রদানের কথা বলেছেন, তেমনই ম্যাকিয়াভেলিও তাঁর গ্রন্থের রাজকুমারকে ক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি তা সুরক্ষিতকরণ ও সম্প্রসারণের দিকে নজর দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

(iii) রাষ্ট্রপরিচালনায় নীতি: রাষ্ট্রপরিচালনাতে রাজার সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিষয়টি উভয়েই তুলে ধরেছেন। তাছাড়া তাঁদের মতানুসারে, রাজ্যের স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে রাজাকে কূটনীতি, শঠতা, কৌশলগত ধূর্ততা সবকিছুরই আশ্রয় নিতে হবে।

(iv) ইতিহাসবোধ: কৌটিল্য ও ম্যাকিয়াভেলি -উভয় রাষ্ট্রদার্শনিকই তাঁদের পূর্বসূরিগণ কর্তৃক রচিত সাহিত্য গভীরভাবে পাঠ ও বিশ্লেষণ করেছেন-তাঁদের রাষ্ট্রচিন্তা গভীর ইতিহাসবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। সম্ভবত রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলির দিকে লক্ষ রেখে অনেকেই কৌটিল্যকে ভারতের ম্যাকিয়াভেলি বলে উল্লেখ করেছেন। তবে অনেকেই এই অভিধা প্রদানের বিরোধিতাও করেছেন। তাঁরা মনে করেন যে, সময়কালের বিচারে এবং রাষ্ট্রতত্ত্বের নানান বিষয়ে কৌটিল্য ম্যাকিয়াভেলির পূর্বসূরি। রাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্ক, পররাষ্ট্রনীতি-সহ একাধিক বিষয়ে কৌটিল্য বহু পূর্বেই আলোচনা করে গেছেন। তাই ‘ভারতের ম্যাকিয়াভেলি’-এই অভিধা দিতে তাঁরা নারাজ। অবশ্য মিল-অমিল যাই থাকুক না কেন, প্রাচীন ভারতের এক বাস্তববাদী ও শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদার্শনিক হিসেবে কৌটিল্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

৩। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে লেখো।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ সাম্রাজ্য হিসেবে মৌর্য সাম্রাজ্য তথা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে যে উপাদানগুলির উপর আমাদের নির্ভর করতে হয়, সেগুলি হল- কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা, বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস, এ ছাড়া জাস্টিন, আরিয়ান, স্ট্রাবো ও প্লিনির রচনা ইত্যাদি।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থা

(i) কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা

(a) রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা: মৌর্য শাসনব্যবস্থায় রাজাই ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনিই ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান শাসক, আইনপ্রণেতা, বিচারক ও প্রধান সেনাপতি। তবে সকল ক্ষমতার উৎস হলেও মৌর্য শাসনব্যবস্থায় রাজারা কখনোই স্বৈরাচারী ছিলেন না। জনকল্যাণই ছিল তাঁদের শাসনব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য।

(b) সচিব, মন্ত্রীণ ও মন্ত্রীপরিষদ: মৌর্য যুগে সম্রাটকে শাসনকার্যে যারা সাহায্য করতেন, তাদের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন সচিব কর্মচারীগণ। সচিবদের মধ্যে থেকে আবার অভিজ্ঞ ও যোগ্য ব্যক্তিদের মন্ত্রী বা মন্ত্রীণ পদে নিয়োগ করা হত। তারা শাসননীতি ও পররাষ্ট্র সম্পর্কে রাজাকে পরামর্শ প্রদান করতেন। অন্যদিকে মন্ত্রীপরিষদ নামক সভা ছিল, যার সদস্যগণ কেবলমাত্র জরুরিকালীন অবস্থায় রাজাকে পরামর্শ দিতেন। এ ছাড়া অমাত্য, অধ্যক্ষ, করণিক, দৌবারিক, প্রতিবেদক ইত্যাদি নানা ধরনের কর্মচারীদের অস্তিত্বের কথাও জানা যায়।

(c) সামরিক বিভাগ: মেগাস্থিনিসের বিবরণী থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সুবিশাল সৈন্যবাহিনী সম্পর্কে জানা যায়। ৩০ জন সদস্য দ্বারা গঠিত একটি পরিষদের উপর মৌর্যদের সামরিক বিভাগের দায়িত্ব অর্পিত ছিল। আরও জানা যায় যে, প্রতিটি পরিষদ ৫ জন সদস্য নিয়ে মোট ছয়টি সমিতিতে বিভক্ত ছিল, যথা- পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্তিবাহিনী, রথারোহী, নৌবিভাগ, রসদ সংগ্রহ ও যানবাহন।

(d) বিচারব্যবস্থা: মৌর্য রাজারা ছিলেন বিচারব্যবস্থার প্রধান। অর্থশাস্ত্রে ধর্মস্বীয় ও কণ্টকশোধন -এই দুধরনের বিচারালয়ের উল্লেখ মেলে। আবার গ্রামে গ্রামিক ও নগরে নগর ব্যাবহারিক বিচারব্যবস্থার কার্যাবলি পরিচালনা করতেন বলে জানা যায়। আলোচ্য পর্বে জরিমানা, অঙ্গচ্ছেদ, মৃত্যুদণ্ড-এর মতো শাস্তি প্রচলিত ছিল।

(e) রাজস্ব: মৌর্য যুগে সরকারের আয়ের প্রধান উৎসই ছিল ভূমিরাজস্ব। উৎপন্ন ফসলের ১/৬ বা ১/৪ অংশ হারে রাজস্ব ধার্য ছিল। এর পাশাপাশি বিক্রয় কর, জলকর, খনিকর, পথকর, বাণিজ্য কর ইত্যাদি থেকেও সরকারের প্রচুর আয় হত।

(ii) প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর সুবিশাল সাম্রাজ্যকে প্রাচ্য, উত্তরাপথ, অবন্তী ও দক্ষিণাপথ-এই ৪টি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। কোথাও কোথাও প্রদেশগুলিকে বলা হত দেশ। প্রদেশগুলির শাসনকর্তারা পরিচিত ছিলেন প্রাদেশিক নামে। মূলত রাজপরিবারগুলি থেকেই প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ নিযুক্ত হতেন, এদের বলা হত আর্যপুত্র। আবার শাসনের সুবিধার্থে প্রদেশগুলিকে কয়েকটি বিষয় বা অহল-এ (জেলা) বিভক্ত করা হত। জেলার প্রধান শাসনকর্তাকে বলা হত সমাহর্তা। মৌর্য শাসনব্যবস্থার সর্বনিম্ন একক ছিল গ্রাম। এই গ্রামের প্রধান পরিচিত ছিলেন গ্রামিক নামে। গোপ-এর অবস্থান ছিল গ্রামিকদের উপরে। তিনি ছিলেন ৫-১০টি গ্রামের প্রধান।

তাছাড়া মেগাস্থিনিস প্রদত্ত বিবরণের মাধ্যমে জানা যায় যে, ৩০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিষদের উপর পাটলিপুত্র নগরীর শাসনদায়িত্ব অর্পিত ছিল। ৬টি শাখায় বিভক্ত এই পরিষদ ৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হত। কৌশাম্বী, উজ্জয়িনী, তক্ষশিলা প্রভৃতি নগরেও একইরকম শাসনব্যবস্থা বজায় ছিল বলে অনুমান করা হয়।

৪। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে আদর্শ রাষ্ট্রের কী কী বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন? অর্থশাস্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার এক সহায়ক উপাদান হিসেবে পরিচিত অর্থশাস্ত্রে আদর্শ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়।

(i) রাষ্ট্রনীতির বিজ্ঞান: কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রীয় সংগঠন, রাজ্যশাসন সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ আলোচনা উপস্থিত। রাষ্ট্রনীতির বিজ্ঞানরূপে এটি বিবেচিত হয়।

(ii) বহুমাত্রিক কাঠামো: কৌটিল্যের এই রাষ্ট্রতত্ত্বের নির্দেশিকায় রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো ছিল বহুমাত্রা সমন্বিত, জনস্বার্থ ও নিরাপত্তাভিত্তিক -যা বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অপর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

(iii) প্রজাকল্যাণের আদর্শ: আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যরূপে অর্থশাস্ত্রে আরও বলা হয়েছে যে, প্রজার সুখে রাজার সুখ, প্রজার হিতসাধনই রাজার অন্যতম লক্ষ্য ও দায়িত্ব হওয়া উচিত।

(iv) দূত নিয়োগ: কৌটিল্য তাঁর গ্রন্থে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খবর আদানপ্রদানের জন্য দূত নিয়োগের উপরে গুরুত্ব দিয়েছেন।

(v) বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য: সর্বোপরি বলা যায় যে, অর্থশাস্ত্রের আলোচনার বিষয়বস্তু নিছক রাজনৈতিক তত্ত্বের মধ্যেই সীমিত, তা বলা যায় না। এর পরিধি বহুধাবিভক্ত। রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনার পাশাপাশি অর্থনীতি, দণ্ডনীতি, রসায়নশাস্ত্র, ইতিহাস, ধাতুবিদ্যা – এরকম নানা বিষয়ের বিজ্ঞানসম্মত ও সুশৃঙ্খল আলোচনা এখানে উপস্থিত।

অর্থশাস্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা

রাষ্ট্রের সামাজিক বা অর্থনৈতিক ভিত্তি, প্রজার প্রতি রাজার দায়িত্ব, মন্ত্রীপরিষদের বিন্যাস, রাজস্বব্যবস্থা, গুপ্তচর বিভাগ, নারীর সম্মান ও অধিকার, প্রশাসনিক ব্যবস্থার যাবতীয় খুঁটিনাটি ধ্যানধারণা অর্থশাস্ত্রে লিপিবদ্ধ আছে, যা বর্তমানেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার জগতে অর্থশাস্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়।

  1. ভারতে কল্যাণকর রাষ্ট্র বা Welfare State-এর বৈশিষ্ট্য অর্থশাস্ত্রে আলোচিত হয়েছে, যা বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক।
  2. নাগরিকদের সুরক্ষা ও অধিকার বিষয়ে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যে আলোচনা উপস্থিত, তাও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
  3. বর্তমান শাসনব্যবস্থায় যা যা অনুসৃত হয়, তার প্রায় অধিকাংশই অর্থশাস্ত্রে আলোচিত হয়েছে। যেমন- দণ্ড, রাজার বিশিষ্টজনের সঙ্গে গোপন বৈঠক, গুপ্তচর ব্যবস্থা, বহুমাত্রিক শাসনপদ্ধতি ইত্যাদি।

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসাই যায় যে, অর্থশাস্ত্র বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।

৫। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত মন্ডলতত্ত্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত মন্ডলতত্ত্ব

কোনও পরাক্রান্ত রাজা রাজ্যশাসন তথা প্রশাসন পরিচালনার সময় পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির সঙ্গে কীরূপ সম্পর্ক স্থাপন করবেন, তার ব্যাখ্যা বা আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ সংক্রান্ত আলোচনাই অর্থশাস্ত্রে মণ্ডলতত্ত্ব নামে পরিচিত। মণ্ডলতত্ত্ব ১২ জন রাজাকে নিয়ে গড়ে ওঠায় এটিকে দ্বাদশ মণ্ডল বা রাজমণ্ডল বলা হয়।

এই ১২ জন রাজার মধ্যে রয়েছেন স্বয়ং বিজিগীষু রাজা, তাঁর সম্মুখভাগে ৫ এবং পশ্চাদ্ভাগে ৪ জন রাজা এবং সেইসঙ্গে রয়েছেন মধ্যম ও উদাসীন রাজা। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী, দ্বাদশ মণ্ডলের কেন্দ্রে বিজিগীষু রাজার (যাঁরা বিশেষ গুণ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার অধিকারী) অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। * সাবধানতা অবলম্বনের পাশাপাশি বিচক্ষণতার সাথে অন্যান্য রাজাদের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ করা বিজিগীষু রাজার কর্তব্য। কৌটিল্য সম্মুখবর্তী ৫ জন রাজাকে বলেছেন- অরি, মিত্র, অরিমিত্র, মিত্রমিত্র এবং অরিমিত্র মিত্র।

(i) অরি: বিজিগীষু রাজার রাজ্যের সীমান্তবর্তী যে-কোনো রাজ্যের রাজা পার্শ্ববর্তী রাজ্য দখলে সক্রিয় হতে পারেন, তাই তিনি অরি বা শত্রু।

(ii) মিত্র: সীমান্তবর্তী যে রাজ্য ‘অরি’-র শত্রু, যে বিজিগীষুর মিত্রপক্ষে থাকবে, সে হল মিত্র বা বন্ধু।

(iii) অরিমিত্র: ‘মিত্র’ রাজার সীমান্তবর্তী রাজা হলেন তাঁর স্বাভাবিক শত্রু। অর্থাৎ, ‘অরি’ রাজার মিত্র এবং বিজিগীষু রাজার অরিমিত্র।

(iv) মিত্রমিত্র: ‘মিত্র’ রাজ্যের রাজার স্বাভাবিক মিত্র রাজা হবেন বিজিগীষু রাজার সমর্থক, তাই তিনি মিত্রমিত্র।

(v) অরিমিত্র মিত্র: ‘মিত্রমিত্র’ রাজ্যের সীমান্তবর্তী রাজা হলেন ‘মিত্রমিত্র’-এর শত্রু এবং ‘অরিমিত্র’-এর স্বাভাবিক বন্ধু। তাই তিনি বিজিগীষু রাজার ‘অরিমিত্র মিত্র’।

এ ছাড়া অর্থশাস্ত্রে বিজিগীষু রাজার পশ্চাদ্ভাগের যে ৪ জন রাজার কথা বলা হয়েছে, তাঁরা হলেন-

(i) পার্শ্বিগ্রাহ: পার্শ্বিগ্রাহ অর্থাৎ, পশ্চাদ্বর্তী অঞ্চলের রাজা। তিনি বিজিগীষু রাজার শত্রু এবং ‘অরি’-র মিত্র।

(ii) আকুন্দ: আক্রন্দ অর্থাৎ, পার্শ্বিগ্রাহ রাজ্যের ঠিক পিছনে অবস্থিত রাজ্য এবং পার্শ্বিগ্রাহ-র শত্রু। সেই কারণে বিজিগীষু রাজ্যের মিত্র।

(iii) পার্ষ্ণিগ্রাহাসার: আক্রন্দ রাজ্যের ঠিক পিছনে পার্শ্বিগ্রাহাসার-এর অবস্থান। সেই রাজ্য স্বভাবতই পার্শ্বিগ্রাহের মিত্র এবং বিজিগীষু রাজ্যের শত্রু।

(iv) আকুন্দাসার: আক্রন্দাসার অর্থাৎ, যে রাজ্যের অবস্থান পার্শ্বিগ্রাহাসার রাজ্যের ঠিক পিছনে। এটি আক্রন্দ রাজ্যের মিত্র, তাই বিজিগীষুরও মিত্র।

এর পাশাপাশি কৌটিল্য আরও দুজন রাজার কথা বলেছেন, যথা- মধ্যম ও উদাসীন।

(i) মধ্যম: যে রাজার রাজ্য বিজিগীষু ও অরি রাজ্যের সীমান্তে (মধ্যবর্তী স্থানে) অবস্থিত, তিনি হলেন মধ্যম। এই রাজা বিজিগীষু বা অরি রাজ্য কাউকেই আক্রমণ করতে বা অনুগ্রহ করতে পারেন না।

(ii) উদাসীন: উদাসীন রাজা হলেন সেই রাজ্যের শাসক, যাঁর অবস্থান বিজিগীষু, অরি বা মিত্র রাজ্যের অনেকটা দূরে। এই রাজা একক শক্তিতে অন্য রাজ্যকে আক্রমণ করতে কিংবা অন্য রাজ্যের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম।

গুরুত্ব

রাজমণ্ডল তত্ত্ব দ্বারা কৌটিল্য একজন শাসকের যথার্থ পররাষ্ট্রনীতি রূপায়ণের দিকনির্দেশ করেছেন। ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলির দৃষ্টিভঙ্গি কীরূপ হতে পারে এবং সেই কথা বিবেচনা করে পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হওয়া সম্ভব, তার একটা পূর্বাভাস এই তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়। তাঁর পরামর্শ যে, একজন সঠিক ও বিচক্ষণ রাজা এই তত্ত্বের নিরিখে তাঁর বিদেশনীতির ভারসাম্য রক্ষা করলে পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে সফল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। সর্বপরি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ, বহিঃশত্রুর আক্রমণের মোকাবিলা করা অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণ করতে মন্ডলতত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম।

৬। সচিত্র মন্ডলতত্ত্বের গুরুত্ব আলোচনা করো।

মণ্ডলতত্ত্বের গুরুত্ব

প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, রাষ্ট্রতত্ত্ব তথা পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মণ্ডলতত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি আদর্শ রাষ্ট্রের বিদেশনীতি কীরূপ হওয়া উচিত, তার এক যুগোপযোগী আলোচনা এই তত্ত্বে স্থান পেয়েছে।

(i) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণ: প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণ, বহিঃশত্রুর আক্রমণের মোকাবিলা করা অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণে মণ্ডলতত্ত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

(ii) ঐক্য ও শান্তিরক্ষা: কৌটিল্য বিজিগীষু রাজাকে কেন্দ্র করে মোট ১২ জন রাজার সমবায়ে রাজমণ্ডল গড়ে তুলেছেন। তিনি মনে করেছিলেন যে, এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের ঐক্য, শান্তি ও সুস্থিতি বজায় থাকবে।

(iii) শত্রু-মিত্র নির্ধারণ: দ্বাদশ মণ্ডলের ১২টি রাজ্যের মধ্যে কাকে কীভাবে গ্রহণ করতে হবে, তার সঠিক বিশ্লেষণ মণ্ডলতত্ত্বে আলোচিত হয়েছে। এভাবে প্রকৃত শত্রু ও মিত্র নির্ধারণ করে বিজিগীষু রাজা সকলপ্রকার আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম হবেন বলে অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে।

(iv) ক্ষমতার ভারসাম্য তত্ত্ব: মণ্ডলতত্ত্বে প্রতিটি রাষ্ট্রের সঙ্গে বিজিগীষু রাজ্যের রাজার Balance of Power বা ক্ষমতার ভারসাম্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

(v) বর্তমান যুগে প্রাসঙ্গিকতা: প্রাচীন ভারতে বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মণ্ডলতত্ত্বের গুরুত্ব বর্তমান যুগেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে কৌটিল্য আন্তঃরাজ্য সম্পর্ক পরিচালনার যে নির্দেশ লিপিবদ্ধ করেছেন, তা বর্তমান যুগের পররাষ্ট্রনীতিকেও বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে।

পরিশেষে বলা যায়, প্রাচীন ভারতের মণ্ডলতত্ত্ব সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক হলেও রাষ্ট্রজোট ও পারস্পরিক সম্পর্কের কথা বলে। তাই বর্তমান কালেও এর সমান প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে।

৭। কৌটিল্যের দন্ডনীতি ও তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

কৌটিল্যের দণ্ডনীতি

কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রে দণ্ডনীতির উল্লেখ মেলে। এই দণ্ড শব্দটি ব্যাপক ব্যঞ্জনাময়। কৌটিল্যের মতানুযায়ী, দণ্ড বা শাস্তি এবং শাস্তির ভীতিকে শুধু প্রতিরোধমূলক দিক থেকেই বিচারবিবেচনা করা উচিত নয়। এই দণ্ড সমাজে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করে। অর্থশাস্ত্রের প্রথম অধিকরণে দণ্ডনীতি সম্পর্কিত আলোচনা উপস্থিত।

(i) অর্থশাস্ত্রে দন্ড-লাঠি বা শাস্তি অর্থ: কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে দণ্ডকে লাঠি অর্থে ব্যবহার করেছেন। এখানে ‘দণ্ড’ শব্দের অপর অর্থ হল শাস্তি। সামরিক বাহিনী অর্থে: কৌটিল্য দণ্ড শব্দটি সামরিক বাহিনী -এই অর্থেও ব্যবহার করেছেন।

(ii) শাস্তিপ্রদানের কৌশল অর্থে: আবার কৌটিল্য দণ্ডনীতিকে শাস্তিপ্রদানের কৌশল (art of punishment) রূপেও বর্ণনা করেছেন।

(iii) ক্ষমতা অর্থে: অনেকে বলেন, আধুনিক রাজনীতিতে ক্ষমতা বিজ্ঞান শব্দটি যে অর্থে ব্যবহার করা হয়, দণ্ডনীতি ছিল সেই ধরনের ধারণারই প্রকাশ। কৌটিল্য দণ্ডনীতির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল ও বলপ্রয়োগের বস্তুগত ধারণা তুলে ধরতে চেয়েছেন। তিনি ক্ষমতাতত্ত্বকে রাষ্ট্রপরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বলে মনে করতেন।

কৌটিল্যের দণ্ডনীতির বৈশিষ্ট্য

কৌটিল্যের দণ্ডনীতির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।

(i) শৃঙ্খলা: দণ্ড হল শৃঙ্খলার বন্ধনে আবদ্ধ। ড. বিশ্বনাথ প্রসাদ ভার্মা বলেছেন, ‘Danda is rooted in discipline’। কারণ হিসেবে বলা হয়, সকল সজীব প্রাণীর নিরাপত্তা ও মঙ্গলের জন্য দণ্ড প্রয়োজন।

(ii) বিভিন্ন অর্থে প্রয়োগ: কৌটিল্য দণ্ডনীতিকে লাঠি বা সেনা অর্থে ব্যবহার করেছেন। তিনি ‘দণ্ডপানি’ শব্দেরও প্রয়োগ করেছেন। তাঁর মতে, দণ্ডের কলাকৌশল (art) বিভিন্ন বিষয়ের (অধিগ্রহণ, বৃদ্ধি ও বণ্টন পদ্ধতি) সঙ্গে যুক্ত।

(iii) উপযুক্ত দণ্ড: কৌটিল্যের মতে, লঘুপাপে গুরুদণ্ড জনসাধারণকে ক্ষুব্ধ করে। আবার গুরুপাপে লঘুদণ্ড রাজাকে বিপদগ্রস্ত করে। সুতরাং, যথাযথ বিচারবিবেচনা করেই দণ্ড প্রদান করা উচিত।

(iv) সুন্দর সমাজগঠন: কৌটিল্যের মতে, দণ্ডনীতির সাহায্যেই রাজা ধনী-দরিদ্র, শক্তিমান-দুর্বল-এর মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলেন।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দণ্ডনীতি একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। মানুষের বিচ্যুতির বিরুদ্ধে দণ্ড বিশেষ কার্যকর। তাই কৌটিল্যের দণ্ডনীতি গভীর অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ।

৮। রাজার ক্ষমতা ও গুণাবলি সম্পর্কে অর্থশাস্ত্রে কী বলা হয়েছে?

প্রাচীন ভারতীয় রাষ্ট্রনীতি এবং রাজনীতিচর্চার ক্ষেত্রে কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্র হল একটি আকর গ্রন্থ। রাষ্ট্রশাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন নীতি লিপিবদ্ধকরণের পাশাপাশি উক্ত গ্রন্থে রাষ্ট্রের শাসক বা রাজার ক্ষমতা, গুণাবলি ও কার্যাবলি সম্পর্কেও বহু মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়।

রাজার ক্ষমতা

অর্থশাস্ত্রের আলোচনা অনুযায়ী, রাজা ছিলেন বহুবিধ ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। কৌটিল্যের মতানুযায়ী, সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার শীর্ষে রাজার অধিষ্ঠান- তিনিই যাবতীয় পার্থিব বিষয়ে চূড়ান্ত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তবে এক্ষেত্রে কোনোভাবেই রাজার অবাধ ও শর্তহীন ক্ষমতাকে স্বীকার করা হয়নি। কৌটিল্য-র মতে, রাজার বহুবিধ ও ব্যাপক ক্ষমতা থাকলেও তা ছিল সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজা মন্ত্রীদের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন, যদিও সেই পরামর্শ গ্রহণ করতে তিনি বাধ্য নন।

রাজার গুণাবলি

কৌটিল্যের বক্তব্য অনুসারে রাজা গুরুদায়িত্ব সম্পাদনের জন্য রাজা অপরিহার্য চতুর্বিধ গুণের অধিকারী হবেন।

(i) উত্থান গুণ বা উৎসাহ গুণ: উত্থান গুণ (উৎসাহ গুণ) হল সর্বদা সবস্থানে সকল কাজে নিযুক্ত থাকার গুণ- এই গুণের দ্বারা রাজার মধ্যে থাকবে উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং কর্মপ্রেরণা, পাশাপাশি সাহস ও অতি দ্রুততার সঙ্গে কোনও কাজ সম্পন্ন করার ক্ষমতা। রাজার মধ্যে এই গুণগুলি থাকলে রাজকর্মচারীদের মধ্যেও তা ছড়িয়ে পড়বে। অন্যদিকে রাজা উদ্যমহীন হলে প্রজাদের মধ্যেও তার প্রভাব পড়বে এবং সামগ্রিকভাবে রাজ্য ও রাজ্যবাসীর স্বার্থ বিপন্ন হবে।

(ii) অভিগামিক গুণ: ন্যায়পরায়ণতা, ধর্মপরায়ণতা, শত্রুদমনের দক্ষতা, বিবেচনার দৃঢ়তা, বিনয় প্রভৃতি গুণকে রাজার অভিগামিক গুণ বলা হয়। রাজার এইসব গুণ থাকলে প্রজারা রাজার প্রতি আকৃষ্ট হবে এবং রাজার আনুগত্য স্বীকার করবে।

(iii) ব্যক্তিগত গুণ: বিপদে-আপদে সংযম ও স্থিরতা, বাষ্পটুতা, ইন্দ্রিয় সংযম, প্রখর ধীশক্তি, প্রসন্নচিত্তে মনোভাব গোপন করার ক্ষমতা, তীক্ষ্ণ মেধা ইত্যাদি হল রাজার ব্যক্তিগত গুণ। এই সকল গুণাবলি রাজার অমূল্য সম্পদ বলে বিবেচিত হয়।

(iv) প্রজ্ঞাগুণ: রাজার প্রজ্ঞাগুণ বলতে কৌটিল্য মনে করেন যে, রাজা হবেন প্রখর স্মৃতিশক্তি, নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ও যে-কোনো সমস্যাসমাধানের ক্ষমতার অধিকারী। এই সকল গুণাবলি রাজাকে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করে তুলবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজার প্রজ্ঞাগুণ রাজকার্য সম্পাদনে বিশেষ সহায়তা করে।

মূল্যায়ন

কৌটিল্যের মতে, আদর্শ রাজা হবেন একইসঙ্গে রাজা এবং ঋষি উভয়ের গুণের সমাহার। ইন্দ্রিয়সংযমী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ষড়রিপু, অর্থাৎ ক্রোধ, কাম, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য প্রভৃতি তাঁর বশীভূত হবে। তিনি আরও বলেন, রাজা হবেন কর্মতৎপর ও সত্যভাষী। তিনি সর্বদা মার্জিত আচরণ অবলম্বন করবেন এবং সর্বপ্রকার চিত্তচাঞ্চল্যকে জয় করে বিশেষ গুণসম্পন্ন আদর্শ রাজায় পরিণত হবেন।

৯। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে রাজার প্রধান কর্তব্য সম্পর্কে যেসকল পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত রাজার প্রধান কর্তব্যসমূহ

রাজার প্রধান কর্তব্যগুলি সম্পর্কে কৌটিল্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উল্লেখ করেছেন-

(i) শাসন সংকান্ত কর্তব্য: একজন রাজার শাসন সংক্রান্ত কর্তব্যকর্মের উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে রাজা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সামাজিক শান্তিবিঘ্নকারী দুষ্কৃতিদেরও দমন করবেন।

(ii) মন্ত্রী-অমাত্যবর্গের নিয়োগ সংক্রান্ত কর্তব্য: রাজার অপর প্রধান কর্তব্য হল মন্ত্রী-অমাত্য ও অন্যান্য পদস্থ কর্মচারীদের নিয়োগ করা। কৌটিল্যের মতে, রাজা তাঁর মন্ত্রীর সংখ্যা তিন বা চারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবেন। তাছাড়া মন্ত্রী, অমাত্য ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজা তাদের বাগ্মীতা, দক্ষতা, সদাচার, বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা, ধৈর্যশীলতা ইত্যাদির উপর গুরুত্ব দেবেন।

(iii) প্রজাদের নিরাপত্তা প্রদান: কৌটিল্য রাজার প্রধান কর্তব্যসমূহের আলোচনায় বলেছেন যে, রাজা দেবরাজ ইন্দ্রের মতো প্রজাদের রক্ষা এবং যমরাজের মতো অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করে জনগণের নিরাপত্তা বিধান করবেন।

(iv) জনকল্যাণসাধন: কৌটিল্যের মতে, প্রজাদের যাবতীয় স্বার্থরক্ষা রাজার কর্তব্য এবং তাদের সুখই প্রকৃতপক্ষে রাজার সুখ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। এ ছাড়া রাজা ধনী-দরিদ্রের সামাজিক ব্যবধান দূর করতেও সচেষ্ট হবেন। প্রজাকল্যাণের প্রয়োজনে তাঁর হৃদয় হবে কোমল এবং রাজকোশ থাকবে উন্মুক্ত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়কালে রাজা খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান ও শস্যবীজ দান করে প্রজাকল্যাণ সাধনে সচেষ্ট হবেন। এর পাশাপাশি অসমর্থ, বয়স্ক, বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা নাগরিকদের সুরক্ষা ও ভরণপোষণ দিতেও রাষ্ট্র দায়বদ্ধ থাকবে। আবশ্যিক পণ্যের মজুতদারি, কালোবাজারি, ভেজাল দেওয়া ইত্যাদি কাজে লিপ্ত মানুষদের নিবৃত্ত করার কাজে রাজা কঠোর মনোভাব গ্রহণ করবেন।

(v) পোরান পকিতি: ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত পোরান পকিতি বা প্রাকৃতিক আইনের উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখিয়েছেন যে, মৌর্য আমলের বহুপূর্ব থেকেই কিছু প্রচলিত নিয়মকানুন প্রজাদের কল্যাণসাধনে পালিত হত। এই প্রকার বিধিবিধান কোনও শাসকই উপেক্ষা করতে পারতেন না।

(vi) সামাজিক কর্তব্য পালন: রাষ্ট্র ও সমাজকে রক্ষা করা রাজার অপর প্রধান কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। এ ব্যাপারে রাজা যে নানান প্রশাসনিক সাহায্য নেবেন সেকথাও অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে। রাষ্ট্রের ভিতর ও বাইরের খবর সংগ্রহ করার জন্য রাজা গুপ্তচর নিয়োগ করবেন বলে উল্লেখ করা হয়। গুপ্তচর সূত্রে প্রাপ্ত খবরাখবর বিচারবিবেচনার মাধ্যমে রাজা সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজদূতগণও গুপ্তচরের কাজ করতেন।

১০। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে রাজার অন্যান্য কর্তব্য সম্পর্কে যেসকল পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করো।

অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত রাজার অন্যান্য কর্তব্যসমূহ

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে একজন রাজার কিছু প্রধান কর্তব্যের পাশাপাশি আরও অন্যান্য কর্তব্যের কথাও বলা হয়েছে। রাজা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, রাজা নিজের ক্ষমতা জারি করার জন্য বিপক্ষের পরিকল্পনা দমন করবেন। এমনকি কূটনীতি, ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজাদের নিয়ন্ত্রণে আনবেন।

(i) শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন: কৌটিল্যের মতে, রাজার প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্ভর করে তার শক্তিশালী সেনাবাহিনীর উপর। সুদক্ষ সেনাবাহিনী গঠনের মাধ্যমে তিনি শত্রুরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান প্রতিহত করতে ও প্রয়োজনে শত্রুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান করতে পারেন। অন্যদিকে হাতি, ঘোড়া, রথ ও পদাতিক বাহিনী গঠনের পাশাপাশি সেনাধ্যক্ষ নিয়োগের ব্যাপারেও রাজা দৃষ্টি রাখবেন। এ ছাড়া প্রতিদিন সামরিক বাহিনীর তদারকির বিষয়টি রাজার অন্যতম কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়।

(ii) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী, রাজা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। তিনিই রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার প্রধান। অর্থশাস্ত্রে আরও বলা হয় যে, দেওয়ানি মামলার বিচার করবেন ‘ধর্মস্থ’ নামক তিনজন মহামাত্র এবং ফৌজদারি মামলার বিচার করবেন ‘প্রদেষ্ট’ নামক তিনজন মহামাত্র। এর পাশাপাশি বলা হয় ‘কণ্টকশোধন’ আদালতে চুরি-ডাকাতি, প্রতারণা প্রভৃতি মামলার বিচার হবে এবং এই বিচারের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রাজার কাছে আবেদন করা যাবে।

(iii) সরকারি প্রশাসনে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ: অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে, রাজা নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি প্রশাসনে কর্মচারীদের নিয়োগ করবেন। প্রশাসনের শীর্ষে থাকার কারণে রাজা সামরিক বাহিনীর প্রধান বা সেনানায়কদের নির্বাচন করবেন। তিনি যোগ্যতার ভিত্তিতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচারকদেরও নিয়োগ করবেন বলে উল্লেখ করা হয়। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ বা প্রধান পুরোহিত নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাজা তার যোগ্যতা যাচাই করবেন বলে অর্থশাস্ত্রে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

(iv) আর্থিক সচ্ছলতা: কৌটিল্যের মত অনুযায়ী, প্রজাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য নির্ভর করে রাজ্যের আর্থিক সচ্ছলতার উপর। তাই রাজা নানাভাবে আর্থিক উন্নতির প্রচেষ্টা চালাবেন। রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য তিনি কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের ব্যাপারে উদ্যোগী হবেন। রাজকোশ সর্বদা পরিপূর্ণ রেখে জনগণের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বিধান করাই হল রাজার অপর গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।

(v) জনবসতি স্থাপন: কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে জনপদনিবেশ অর্থাৎ নতুন জনবসতি গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা মহামারির ফলে জনবসতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে রাজা সেখানে পুনরায় জনবসতি স্থাপন করবেন। এ ছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল থেকে মানুষদের নিয়ে এসে বসতি গঠন করাও ছিল রাজার কর্তব্য।

(vi) দৈনন্দিন কর্তব্যপালন: অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য রাজার দৈনন্দিন পালিত কর্তব্যকর্মের একটি তালিকা প্রদান করেছেন। এতে বলা হয়, দিন ও রাতের বিভিন্ন সময় রাজা নির্দিষ্ট কর্তব্য পালন করবেন। এই সকল কাজের মধ্যে রাজার খাদ্যগ্রহণ ও বিশ্রামের সময় থাকবে ৭ ঘণ্টা। কৌটিল্যের মতে, রাজা যদি পরিশ্রমী ও সক্রিয় হন তাহলে তাঁর রাজ্যের প্রজা, মন্ত্রীপরিষদ প্রত্যেকেই কর্তব্যনিষ্ঠ হয়। ফলে রাজ্যের সমৃদ্ধি ঘটে।

১১। মৌর্য শাসনব্যবস্থার উপাদানরূপে অর্থশাস্ত্রের গুরুত্ব আলোচনা করো।

মৌর্য শাসনব্যবস্থার উপাদানরূপে অর্থশাস্ত্রের গুরুত্ব

একসময় মনে করা হত, অর্থশাস্ত্র মৌর্য যুগে লেখা একটি গ্রন্থ। চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী চাণক্য বা কৌটিল্য এর রচয়িতা। কিন্তু পরবর্তীকালের গবেষণায় জানা গেছে যে, অর্থশাস্ত্রের সব অংশ মৌর্য যুগের লেখা নয়, অনেক পরের রচনা। কিথ, উইন্টারনিৎজ, জলি প্রমুখ ঐতিহাসিকরা অর্থশাস্ত্রকে কেবলমাত্র মৌর্য যুগের ইতিহাসের উপাদান বলতে নারাজ। এ প্রসঙ্গে তাঁদের যুক্তিগুলি হল-

  1. অর্থশাস্ত্র মূলত খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকের রচনা এবং গ্রন্থটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পক্ষে উপযুক্ত যেখানে চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যের পরিধি ছিল বিশাল।
  2. এতে চিনা রেশমের উল্লেখ আছে কিন্তু মৌর্য যুগে চিনের সঙ্গে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের উল্লেখ তাঁরা পাননি। এইসব কারণগুলি দেখিয়ে তাঁরা অর্থশাস্ত্র মৌর্য যুগের রচনা ছিল কি না সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

তাছাড়া বহু গবেষক মনে করেন, অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি একটি উপদেশমূলক রচনা। এটি বিশেষ কোনও রাষ্ট্র, সাম্রাজ্য বা শাসনব্যবস্থাকে নিয়ে লেখা নয়; এর উপদেশাবলি সবার জন্য। ফলে এক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে।

অর্থশাস্ত্রের নিরিখে মৌর্য শাসনব্যবস্থার স্বরূপ: কোনও কোনও ঐতিহাসিক অবশ্য অর্থশাস্ত্রকে মৌর্য আমলের ইতিহাস রচনার উপাদানরূপে ব্যবহার করা সম্ভব বলে মনে করেছেন। গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা, অশোকের লেখসমূহ প্রভৃতির সঙ্গে বিচার করে অর্থশাস্ত্রকে মৌর্য শাসনব্যবস্থার উপাদানরূপে গ্রহণ করা হয়।

  1. মৌর্য সাম্রাজ্যে এক সুনিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থা চালু ছিল। রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন রাজা স্বয়ং। তাঁকে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও সর্বোচ্চ বিচারক হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি অবাধ ক্ষমতার অধিকারী হলেও অর্থশাস্ত্রে তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কঠোর নির্দেশ পাওয়া যায়। রাজা ‘মহারাজা’ ও ‘অমাত্য’ নামধারী রাজকর্মচারী নিয়োগ করতেন এবং মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শক্রমে রাষ্ট্র শাসন করতেন। মেগাস্থিনিসের বিবরণও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে এই মতগুলিকে সমর্থন করে।
  2. মৌর্য অর্থনীতি ছিল রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত। এক্ষেত্রে রাজস্বনীতির গুরুত্ব ছিল। রাজস্বের সিংহভাগটাই আসত ভূমিরাজস্ব থেকে। অর্থশাস্ত্রে আপৎকালীন করকে বলা হত প্রণয় কর। কৃষক, কারিগর, বণিক এমনকি বারাঙ্গনারাও উপহারে এই প্রণয় কর দিত।
  3. মৌর্য সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। তবে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার বিবরণ অর্থশাস্ত্রে তেমনভাবে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া ইন্ডিকা থেকে নগর প্রশাসনের কথা জানা যায়।

অর্থশাস্ত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা: বহু ঐতিহাসিক বলেন, অর্থশাস্ত্রকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে মৌর্য ইতিহাস পর্যালোচনা করলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। যেমন- অর্থশাস্ত্রে এক অতিকেন্দ্রিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ছবি ফুটে উঠেছে। যেক্ষেত্রে সমাজ ও অর্থনীতির সবকিছুই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাধীন। মৌর্য সাম্রাজ্য সম্পর্কেও একসময় এই একই কথা ভাবা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে এই ভাবনার পরিবর্তন ঘটে।

অর্থশাস্ত্রের নির্দেশ ও মৌর্য শাসনব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য: অর্থশাস্ত্রের নির্দেশের সঙ্গে মৌর্য শাসনব্যবস্থার বেশকিছু পার্থক্যও দেখা যায়। যেমন- কৌটিল্য রাজপুরোহিতের উপর গুরুত্ব দিলেও, মৌর্য সম্রাটদের ধর্মবিশ্বাস ও রীতিনীতি পালনের ক্ষেত্রে রাজপুরোহিতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকৃত হয় না। অশোক একসময় যুদ্ধনীতি সম্পূর্ণ পরিহার করেছিলেন, যা অর্থশাস্ত্রের নির্দেশের সম্পূর্ণ বিপরীত। সর্বোপরি অর্থশাস্ত্র এবং অশোকের শিলালেখতে ধর্মবিজয়ের কথা থাকলেও উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য দেখা যায়।

মিল-অমিল, তর্ক-বিতর্ক থাকলেও মৌর্য আমলের ইতিহাসের ক্ষেত্রে অর্থশাস্ত্র একটি সহযোগী উপাদানরূপে গুরুত্বপূর্ণ।

১২। জিয়াউদ্দিন বারানি কে ছিলেন? তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

ভারতের মধ্যযুগের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছিলেন জিয়াউদ্দিন বারানি (১২৮৫-১৩৫৯ খ্রিস্টাব্দ)। দিল্লি সুলতানির শাসনকালে (১২০৬-১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ) ইতিহাসচর্চার নির্ভরযোগ্য উপাদান ছিল বারানির রচনাবলি। তাঁর রচিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক গ্রন্থ হল- তারিখ-ই- ফিরোজশাহী ও ফতোয়া-ই-জাহান্দারি।

জিয়াউদ্দিন বারানির পরিচয়

১২৮৫ খ্রিস্টাব্দে উত্তরপ্রদেশের বারান নামক স্থানে এক অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জিয়াউদ্দিন। এ কারণেই তিনি জিয়াউদ্দিন বারানি নামে পরিচিত হন। তাঁর মাতামহ হুসামউদ্দিন সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের প্রিয়পাত্র ছিলেন। অন্যদিকে তাঁর পিতা মঈদুল মুলক, সুলতান জালালউদ্দিন খলজির পুত্র আরকলি খানের ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। জিয়াউদ্দিন স্বয়ং দীর্ঘ সতেরো বছর মহম্মদ বিন তুঘলকের সভাসদ ছিলেন। পরবর্তীকালে ফিরোজ শাহ তুঘলক সিংহাসনে বসলে (১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর সুদিনের অবসান ঘটে। সুলতান-বিরোধী ষড়যন্ত্রকারী খাজা জাহানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগে বারানিকে পদচ্যুত করা হয়।

জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত গ্রন্থসমূহ

ফিরোজ শাহ কর্তৃক পদচ্যুত হওয়ার পরবর্তীতে জিয়াউদ্দিন বারানি গ্রন্থ রচনায় মন দেন। ১৩৫২ থেকে ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেন, যথা- তারিখ-ই-ফিরোজশাহী ও ফতোয়া-ই-জাহান্দারি। তারিখ-ই-ফিরোজশাহী গ্রন্থটি সুলতান ফিরোজ শাহের নামে উৎসর্গ করে বারানি সুলতানকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। এর সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে তিনি লিখেছিলেন ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থটি। তারিখ-ই-ফিরোজশাহীতে বারানি গিয়াসউদ্দিন বলবন থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বের প্রথম ৬ বছরের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। অন্যদিকে ফতোয়া-ই-জাহান্দারির বিষয়বস্তু ছিল মূলত রাষ্ট্রনীতি ও রাজার (সুলতান) ভূমিকা।

(i) তারিখ ই ফিরোজশাহী: জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত তারিখ-ই-ফিরোজশাহী গ্রন্থটি থেকে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের রাজত্বকাল থেকে শুরু করে ফিরোজ শাহ তুঘলকের প্রথম ৬ বছরের শাসনকাল পর্যন্ত অর্থাৎ, মোট ৮ জন সুলতানের প্রায় একশো বছরের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। উক্ত গ্রন্থের ভূমিকাতেই তিনি একজন ইতিহাসকার হিসেবে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন। বিভিন্ন সুলতান ও অভিজাত আমলাদের কথোপকথনের বর্ণনাও পাওয়া যায় এই গ্রন্থে। যেমন-সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের সঙ্গে তাঁর পুত্র মহম্মদ ও নাসিরুদ্দিন বুগরা খানের কথোপকথন, সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের সঙ্গে বারানির নিজের কথোপকথন ইত্যাদি। এই সকল তথ্য থেকে সমকালীন ধর্ম, প্রশাসন ও রাজনীতি সংক্রান্ত ধারণা পাওয়া যায়, যা দিল্লির সুলতানি শাসন ও জনজীবন সম্পর্কে জানতে ঐতিহাসিকদের প্রভৃত সহায়তা করে। ঐতিহাসিক সামসুল হক-এর মতে, ‘মধ্যযুগের ঐতিহাসিকদের মধ্যে বারানি শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারেন।’

(ii) ফতোয়া-ই-জাহান্দারি: ১৩৫০-এর দশকে জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে সুলতানি যুগে ভারতের রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা। অনেকে মনে করেন যে, দীর্ঘ ১৭ বছর মহম্মদ বিন তুঘলকের সভাসদ থাকার দরুন যেহেতু বারানি সরাসরি সরকারি নথিপত্র দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাই তাঁর প্রদান করা তথ্যসমূহ অন্যান্য সমকালীন ঐতিহাসিকদের তুলনায় বেশি নির্ভরযোগ্য। বারানি রচিত এই গ্রন্থ থেকে ইসলাম ধর্মতত্ত্ব ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক, সুলতানি শাসনের স্বরূপ, সুলতানের প্রয়োজনীয় গুণাবলি, শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। এই গ্রন্থে তিনি রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয় এ বিষয়ে চব্বিশটি উপদেশ লিপিবদ্ধ করেছেন। বারানির রাষ্ট্রভাবনা, রাজতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত প্রদানে গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিসীম।

১৩। বারানি রচিত ফতোয়া-ই-জাহান্দারি থেকে মধ্যযুগের সুলতানের ইসলামি কর্তব্যগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থে উল্লিখিত সুলতানি ইসলামি কর্তব্যসমূহ

(i) শাসকদের শরিয়ত মান্য করা: মুসলিম জগতে শরিয়তি আইন হল সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নির্দেশ। তাই বারানির মতে, মধ্যযুগে সুলতানি শাসকের প্রধান কর্তব্যই হল শরিয়ত বা ইসলামের আদর্শকে রক্ষা করা।

(ii) আইনের সংরক্ষণ: ফতোয়া-ই-জাহান্দারিতে সুলতানের ইসলামি কর্তব্য হিসেবে শরিয়ত বা ধর্মীয় আইনের সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে সুলতান প্রয়োজনমতো এই বিধানের সংশোধন বা পরিমার্জনও করতে পারেন।

(iii) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা: ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী, ইনসাফ বা ন্যায়বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এই বিধান অনুসারে সুলতানি রাষ্ট্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হল সুলতানের প্রধান কর্তব্য। বারানির মতে, ন্যায়বিচার হল মূলত সত্য, ন্যায় ও ধর্মের প্রতিষ্ঠা। তিনি আরও জানিয়েছেন যে, ঈশ্বর বা আল্লাহ্ প্রত্যেক মানুষকে সমান অধিকার দান করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, তাই সুলতানের প্রাথমিক কর্তব্য হল প্রজাদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তা রক্ষা করা।

(iv) প্রজাদের ধর্মপথে পরিচালনা: সুলতান প্রজাদের ধর্মপথে চালিত করার কাজে নেতৃত্ব দেবেন। অবশ্য বারানি ধর্মপথ বলতে কেবল ইসলাম ধর্মের প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন।

(v) অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ: ইসলামীয় বিধান অনুসারে উৎপন্ন শস্যের ২০%-এর কম বা ৫০%-এর বেশি নয়- এই হারে ভূমিকর আদায় বৈধ। তাই বারানির মতে, ভূমিকর আদায়ের সময় যাতে কৃষকদের উপর অত্যাচার না করা হয়, সে বিষয়ে সুলতানকে সচেতন হতে হবে। তবে ইসলামীয় বিধানের বাইরে আদায় করা অন্যান্য করগুলি অবৈধ।

১৪। বারানি রচিত ফতোয়া-ই-জাহান্দারি থেকে মধ্যযুগের সুলতানের অন্যান্য কর্তব্যগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।

ফতোয়া-ই জাহান্দারি গ্রন্থে উল্লিখিত সুলতানি শাসকদের অন্যান্য কর্তব্যসমূহ

(i) পদমর্যাদা রক্ষা: বারানির মতে, সুলতানের অন্যতম কর্তব্য হল দরবারে নিজ গাম্ভীর্য বজায় রাখা। জমকালো পোশাক ও জাঁকজমকপূর্ণ রাজসভা গঠনের মাধ্যমে তিনি প্রজাবর্গের আনুগত্য আদায় করবেন।

(ii) সেনাবাহিনী গঠন: জিয়াউদ্দিন বারানি বলেছেন, বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা, নতুন রাজ্য জয় এবং অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার তাগিদে একটি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করা হল মুসলমান শাসকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কর্তব্য।

(iii) সম্পত্তির অধিকার রক্ষা: ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে সুলতানের অপর গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হল কোনও মানুষ যেন তার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, তা দেখা। তাই সম্পত্তিতে যাতে প্রত্যেকের সমান অধিকার থাকে, সে বিষয়ে সুলতানকে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

(iv) গুপ্তচর নিয়োগ: সুলতানকে সমগ্র রাজ্যের সংবাদ বিষয়ে প্রতিনিয়ত অবহিত থাকতে হবে। এর জন্য তিনি একটি সুদক্ষ গুপ্তচর বাহিনী গঠন করবেন।

(v) পরামর্শসভা গঠন: অনিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচারিতা রোধের উদ্দেশ্যে বারানি শাসককে একটি পরামর্শসভা গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন। বলাবাহুল্য অভিজ্ঞ, বিচক্ষণ, ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিবর্গই হবেন এর সদস্য। বারানির মতানুযায়ী একমাত্র ঈশ্বরে অনুরাগী শাসকই প্রকৃত অভিজ্ঞ ও জ্ঞানীদের পরামর্শ গ্রহণ করে থাকেন।

১৫। ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ও এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?

ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র

গ্রিক শব্দ Theos থেকে উৎপত্তি ঘটেছে Theocracy বা দেবতাতন্ত্র শব্দটির। এই Theos-এর অর্থ হল ঈশ্বর। আর এখান থেকেই এসেছে Theocratic State বা ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের ধারণাটি। ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্র বলতে মূলত সেই সকল রাষ্ট্রকে বোঝায় যেখানে ঈশ্বর হলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তিনি কোনও প্রতিনিধি মনোনীত করে রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করেন।

ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ

ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ-

(i) সার্বভৌমত্ব: যে-কোনো ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রেই ঈশ্বরই হলেন সমস্ত ক্ষমতার উৎস। তিনিই ইহলোক বা পরলোকের প্রভু। রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব বা শক্তি তাঁর দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। তাঁর ইঙ্গিতেই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আবর্তিত হয়। ঈশ্বরের ইচ্ছার ফলশ্রুতিই হল এই জগৎসংসার। পৃথিবীতে সুলতান বা শাসক হলেন তাঁরই প্রতিনিধি। তাই ঈশ্বরের ইচ্ছাকে কার্যে পরিণত করাই সুলতানের প্রধান কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়।

(ii) আইন ব্যবস্থা: ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রে মনুষ্যসৃষ্ট আইনের পরিবর্তে ঈশ্বর নির্দেশিত আইনের ভিত্তিতে শাসন, বিচার ও আর্থিকব্যবস্থা পরিচালিত হয়। যেমন- একটি ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিচালনার জন্য যে-সমস্ত বিধিবিধান প্রয়োজন, তা আল্লাহর বাণীস্বরূপ পবিত্র কোরানের বিভিন্ন অংশে বর্ণিত আছে (উদাহরণ- অমুসলমানদের ধর্মপালনের স্বাধীনতা, করব্যবস্থা, নারী ও দাসদের অধিকার, বিচারব্যবস্থা প্রভৃতি)।

(iii) ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের প্রাধান্য: ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গের প্রাধান্য ছিল ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রের অপর একটি বৈশিষ্ট্য। এইপ্রকার রাষ্ট্রে ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ, যথা- উলেমা, মোল্লা, পোপ বা পুরোহিত শ্রেণির বিশেষ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন- ইসলাম ধর্মে রাষ্ট্র এবং ধর্মের প্রধান প্রতিনিধিরূপে খলিফা এবং ইসলামীয় আইনকানুনের ব্যাখ্যাকার হিসেবে উলেমা শ্রেণির প্রাধান্য ছিল সুবিদিত।

(iv) রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থা: ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রে ধর্মীয় বিধিবিধানের সংরক্ষণ ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য শাসককে বহুক্ষেত্রেই স্বৈরাচারী হতে হয়। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, সুলতানি যুগে দিল্লিতে শাসকগণ অমুসলমানদের কাছ থেকে জিজিয়া কর আদায় করতেন।

(v) ঐশী গ্রন্থ: প্রায় প্রতিটি ধর্মেরই নিজস্ব ধর্মীয় তথা ঐশী গ্রন্থ থাকে। যেমন- ইসলাম ধর্মে কোরান, পারসিকদের জেন্দ আবেস্তা ইত্যাদি। একটি ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রপরিচালনায় সেই ধর্মের ঐশী গ্রন্থ অনেকসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৬। জিয়াউদ্দিন বারানি তাঁর ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে কী মতপ্রকাশ করেছেন?

ফতোয়া-ই জাহান্দারি গ্রন্থে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে বারানির মত

মধ্যযুগে ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ জিয়াউদ্দিন বারানি রচিত ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থটিতে সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে-

(i) শরিয়তের নির্দেশ বা ইসলামীয় আদর্শ থেকে বিচ্যুতি: জিয়াউদ্দিন বারানি তাঁর ফতোয়া-ই-জাহান্দারি গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, সুলতানি আমলে সুলতান প্রকাশ্যে শরিয়তের অনুশাসন ও ইসলামের ঐতিহ্য অস্বীকার করতে পারতেন না। তবে তারা উপলব্ধি করেন যে, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন তথা স্বৈরশাসন বজায় রাখতে হলে ধর্মীয় দর্শনকে রাষ্ট্রীয় দর্শনে পরিণত করা চলবে না। বারানির মতে, সুলতানরা বহুক্ষেত্রেই শরিয়তের নির্দেশ অমান্য করতেন, যথা- শরিয়ত অনুযায়ী ইসলামি রাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রাণদণ্ড দান নিষিদ্ধ ছিল। অথচ একমাত্র ফিরোজ শাহ তুঘলক ব্যতীত সমগ্র সুলতানি যুগেই শাস্তি হিসেবে প্রাণদণ্ড দেওয়া হত। শরিয়ত তথা ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী, অমুসলিম বা জিম্মিদের নাগরিক অধিকার অস্বীকৃত ছিল। কিন্তু সুলতানি রাষ্ট্রব্যবস্থায় কমসংখ্যক হলেও হিন্দুরা সরকারি উচ্চপদে নিযুক্ত হতে পারত। সুলতানি আমলে সুদগ্রহণ শরিয়ত বিধিসম্মত ছিল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রয়োজনে সুদগ্রহণকে সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।

(ii) খলিফার প্রতি আপাত আনুগত্য: জিয়াউদ্দিন বারানির মত অনুযায়ী, দিল্লির সুলতানগণ খলিফাদের প্রতি বাহ্যিক আনুগত্য প্রদর্শন করতেন। প্রথমদিকের সুলতানরা অনেকেই রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুযায়ী খলিফার অনুমোদন গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালের অনেক সুলতানই এই অনুমোদনের প্রত্যাশী ছিলেন না (আলাউদ্দিন খলজি, মহম্মদ বিন তুঘলক প্রমুখ)। আবার সুলতানদের মধ্যে অনেকেই নিজ নামে খুতবা পাঠ ও মুদ্রা খোদাই করতেন। মুবারক শাহ নিজেই খলিফা উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে সুলতানি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখা যায়।

(iii) ধর্মীয় দর্শন ও রাষ্ট্রীয় দর্শনের পৃথক্করণ: সুলতান রাষ্ট্রের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী নিয়মকানুন বা জাওয়াবিত প্রণয়ন করেন। অনেকক্ষেত্রেই সেগুলি শরিয়তের বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হত না। শাসনব্যবস্থার সুদৃঢ়করণ ও তাকে দীর্ঘস্থায়ী চরিত্র দেওয়ার জন্য বহুক্ষেত্রেই দিল্লির সুলতানগণ উপলব্ধি করেন যে, ধর্মনীতিকে রাষ্ট্রনীতির থেকে পৃথক করা বিশেষ প্রয়োজন। এভাবে বারানি দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতির বেশকিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন।

আরও পড়ুন – ছুটি গল্পের প্রশ্ন ও উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment