মানবতাবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো

মানবতাবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো

মানবতাবাদ হল মানুষের জীবনের জয়গান। রেনেসাঁ পর্বের মানবতাবাদী আন্দোলন মূলত ছিল একটি সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক আন্দোলন।

মানবতাবাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ

মানবতাবাদ বা মানবতাবাদী চেতনার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়-

(1) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণা: মানবতাবাদ শিক্ষা দেয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের (Individualism)। অর্থাৎ প্রতিটি ব্যক্তি স্বতন্ত্র এবং পৃথক পৃথকভাবে প্রত্যেকেই অন্তর্নিহিত গুণাবলি ও শক্তির অধিকারী।

(2) ধর্মনিরপেক্ষ অস্তিত্ব: মানুষ ঈশ্বরসৃষ্ট জীব। কিন্তু ঈশ্বর মানুষের জীবন পরিচালনা করেননা। ধর্ম বা ধর্মগুরু নয়, মানুষ নিজেই নিজের জীবনের একমাত্র পরিচালক। রেনেসাঁ-প্রসূত ধর্মনিরপেক্ষ ভাবধারার অন্তর্নিহিত অর্থই ছিল- সম্পদ, সুস্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্যচর্চা।

(3) জীবনমুখী চেতনা: মানুষের জীবন নিয়তি বা অদৃশ্য ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না। মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েই জীবনকে চালিত করে। এই আত্মদর্শন বা জীবনমুখী চেতনার প্রকাশ ঘটে মানবতাবাদে।

(4)  সর্বজনীন প্রকাশ: মানবতাবাদের আদর্শ বহু বিস্তৃত। স্টিফেন জে লি (Stephen J Lee) তাঁর Aspects of European History, 1494-1789 নামক গ্রন্থে বলেছেন যে, মানবতাবাদ হল নবজাগরণের যুগের সকল প্রকার সাংস্কৃতিক অনুপ্রেরণার উৎস, যা সাহিত্য, ইতিহাস, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও রাজনৈতিক ধ্যানধারণাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

(5) মহৎ গুণের অধিকারী: মানবতাবাদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যই হল মানুষের চরম উৎকর্ষ ও মর্যাদাকে (the excellence and dignity of man) তুলে ধরা। আদর্শ মানুষ অবশ্যই মহৎ গুণের অধিকারী হবেন, কিন্তু এই মাহাত্ম্য তিনি কখনোই মধ্যযুগের মতো জন্মসূত্রে অর্জন করবেন না। যুক্তিবোধ এবং স্বাধীনতাস্পৃহা সম্পন্ন মানুষ কর্মপ্রচেষ্টা দ্বারা শ্রী ও সম্পদের অধিকারী হবেন।

(6) Studia Humanitatis: মানবতাবাদ মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে (Scholasticism) গ্রহণ করেনি। আগেই বলা হয়েছে যে, মানবতাবাদ ছিল একটি বৌদ্ধিক আন্দোলন। এই আন্দোলনে গ্রিক ও রোমান ধ্রুপদি সভ্যতার বিদ্যা ও জ্ঞানচর্চায় গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই নতুন শিক্ষাদর্শন ধ্রুপদি প্রাচীনত্বের পুনর্জন্ম ঘটায়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত নাগরিকরা নিজ নিজ গৃহে ধ্রুপদি শিক্ষাচর্চার মাধ্যমে মানবতাবাদী দার্শনিক চেতনা বিকাশের উদ্যোগ নিতেন। ইটালিতে প্রাচীন রাজনৈতিক বক্তৃতা বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞান বিকাশের প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। এই জাতীয় বিদ্যাচর্চাকে বলা হত Rhetoric বা বাক্শাস্ত্র। মানবতাবাদের প্রাথমিক পর্বে জ্ঞানচর্চার এই সকল পদ্ধতি Studia Humanitatis নামে পরিচিত।

(7) নতুন যুগচেতনা: মানবতাবাদীরা নতুন যুগচেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। এঁরা সকলেই বিশ্বাস করতেন যে, তাঁরা এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন। মধ্যযুগের তমসা কাটিয়ে এক নতুন যুগের আবির্ভাব ঘটছে। মানুষ ধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে তার ব্যক্তিত্বকে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।

(8) আইনশাস্ত্রের উপর আস্থা: মানবতাবাদে মধ্যযুগীয় অন্ধবিশ্বাস বা ডগমা (Dogma)-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। ধর্মীয় বিধিবিধানের পরিবর্তে আইনশাস্ত্রের বিধান তৈরি করে সমাজকে পরিচালনা করার প্রয়াস নেওয়া হতে থাকে। বোলোনা, পাদুয়া, র‍্যাভেন্না-র বিভিন্ন শিক্ষালয়ে আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন ও চর্চার উল্লেখযোগ্য প্রসার যাজকীয় আইনে আবদ্ধ গতিহীন সমাজজীবনকে নতুনভাবে গতিশীল করে তোলে।

(9) লেখনীর নিরপেক্ষতা: মানবতাবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল প্রকৃত সত্যের উপস্থাপনা। এই সময় জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের জীবনী বা আত্মজীবনী রচনার প্রবণতা দেখা যায়। তবে সেই রচনাতে ব্যক্তির সদ্‌গুণের পাশাপাশি চারিত্রিক ত্রুটি বা দুর্বলতা তুলে ধরার কাজেও অন্যথা করা হত না। যেমন-ভাসারি মাইকেল এঞ্জেলোর জীবনীগ্রন্থে এঞ্জেলোর হিংসুক প্রকৃতি তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি।

আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment