ভক্তিবাদের আদি প্রচারক হিসেবে শংকরাচার্য ও মাধবাচার্যের ভূমিকা লেখো
দক্ষিণ ভারতে আলবার ও নায়নার ভক্তিবাদী সাধকদের প্রচেষ্টায় বিষু ও শিবের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয় প্রায় নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়া হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা। আসলে ভক্তিবাদী সাধকদের সহজ সরল ধর্মমতের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে হিন্দু সংস্কারকরাও হিন্দু ধর্মদর্শনের জটিলতা ও অস্পষ্টতা দূর করে তাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- শংকরাচার্য ও মাধবাচার্য।
শংকরাচার্য
শংকরাচার্য (সম্ভাব্য ৭৮৮ ৮২০ খ্রি.) আনুমানিক অষ্টম শতকের শেষ বা নবম শতকের গোড়ার দিকে কেরলে জন্মগ্রহণ করেন। শোনা যায় যে, জৈনদের অত্যাচারে মাদুরাই থেকে পলায়নে তিনি বাধ্য হন এবং উত্তর ভারতে আসেন। এখানে বিভিন্ন তর্কযুদ্ধে কয়েকজন ধর্মপন্ডিতকে পরাজিত করার সুবাদে সারাদেশে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি মাদুরাইতে ফিরে সহজ-সরল ভাষায় বৈদিক দর্শন ব্যাখ্যায় ব্রতী হন।
(1) মতাদর্শ: শংকরাচার্য ছিলেন অদ্বৈতবাদের প্রবক্তা। তাঁর মতে, ঈশ্বর ও তাঁর সৃষ্ট এই জগৎ এক ও অভিন্ন। বেদান্ত বা উপনিষদই অদ্বৈতবাদের উৎস। তাঁর মতে, ব্রহ্ম সত্য ও জগৎ মিথ্যা।
(2) মতবাদ প্রচার: শংকরাচার্য ভারতের নানান স্থানে পরিভ্রমণ করেন এবং অদ্বৈতবাদের প্রচার করেন। তিনি ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য, বিবেক চূড়ামণি, • গীতাভাষ্য রচনা করেছিলেন। এ ছাড়া শংকরাচার্য পুরি, শৃঙ্গেরী, দ্বারকা ও হিমালয়ে মঠ স্থাপনও করেছিলেন।
মাধবাচার্য
দ্বাদশ শতকের বিশিষ্ট ধর্মতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক মাধবাচার্য (১১৯৯-১২৭৮ খ্রি., তিনি পুণ্যপ্রজ্ঞা বা আনন্দতীর্থ নামেও পরিচিত) হলেন ভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি সম্ভবত ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক অঞ্চলের উডুপিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং বৈষুব ধর্ম প্রচলন ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
(1) মতাদর্শ: মাধবাচার্য দ্বৈতবাদের মুখ্য প্রবক্তা ছিলেন। তাঁর মতে এই বিশ্বের প্রত্যেক পরমাণুতেই প্রাণ আছে। অর্থাৎ প্রত্যেক পরমাণুই জীব। তাঁর মতে, ব্রহ্ম বা ঈশ্বর এবং আত্মা তথা জীবাত্মা হল দুটি আলাদা সত্তা। আত্মা তার মুক্তিলাভের জন্য ঈশ্বরের কৃপা লাভের প্রয়াসী।
(2) মতবাদের প্রচার: ভক্তিমার্গের অন্যতম বিশিষ্ট প্রচারক মাধবাচার্যের কাছে ঈশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তিই হল জীবের মুক্তির পথ। জনমানসে তিনি বিষুর উপাসনা করা এবং তাঁকেই সর্বোচ্চ সত্তা হিসেবে মেনে নেওয়ার কথা ছড়িয়ে দেন। তিনি ভগবদ্গীতা, ঋকবেদ ও কেন উপনিষদের ভাষ্য রচনা করেছিলেন। জয়তীর্থ, শ্রীপদরাজা প্রমুখ ছিলেন তাঁর উল্লেখযোগ্য শিষ্য। উপরোক্ত দুইজন ছাড়াও রামানুজ এবং নিম্বার্ক-এর কথাও উল্লেখযোগ্য। রামানুজের দর্শন বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ নামে পরিচিত। অন্যদিকে দ্বাদশ শতকে নিম্বার্ক দ্বৈতাদ্বৈতবাদ দর্শন প্রবর্তন করেন। তার লেখা একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল বেদান্ত-পারিজাত-সৌরভ। তিনি সনকাদি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বলে জানা যায়।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর