ভক্তিবাদী আন্দোলনের প্রভাবগুলি কী কী ছিল অথবা, ভক্তিবাদী আন্দোলনের গুরুত্ব আলোচনা করো
ভক্তিবাদী আন্দোলনের প্রভাবসমূহ
মধ্যযুগে ভারতীয় জনজীবনে ভক্তিবাদী আন্দোলনের প্রভাব ছিল সুগভীর। তৎকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে ভক্তিবাদ ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
(1) হিন্দু-মুসলিম বিভেদ হ্রাস: ভক্তিবাদের প্রভাবে ভারতীয় সমাজে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা হিন্দু-মুসলিম বিভেদের তীব্রতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। এই দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে ক্রমে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে।
(2) জাতিভেদ প্রথার শিথিলতা বা সামাজিক সচলতা: এদেশে ভক্তি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হল, জাতিভেদ প্রথার শিথিলতা। ভক্তিবাদের মাধ্যমে সমাজে জাতপাত, উচ্চ-নীচ বৈষম্য অনেকাংশে হ্রাস পায় এবং সামাজিক সচলতার সৃষ্টি হয়।
(3) আচার-অনুষ্ঠানের বিরোধিতা: পূর্বে ধর্মপালনের ক্ষেত্রে বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানকে গুরুত্ব প্রদান করা হত। ভক্তি আন্দোলনকালে ধর্মাচার্যগণ এই আচার-অনুষ্ঠানকে বর্জন করেন এবং সামাজিক ব্যাধি দূর করেন।
(4) নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি: ভক্তিবাদী ধর্মপ্রচারকগণ নারী-পুরুষ ভেদাভেদ না মানায় সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। তৎকালে নারীরা অবাধে ধর্মসভায় যোগদান করতে পারতেন।
(5) আঞ্চলিক ভাষায় ধর্মপ্রচার: ভক্তি আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিবর্গ তাঁদের উপদেশদানকালে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত নানান তত্ত্বকে সহজ-সরল স্থানীয় ভাষার মাধ্যমে প্রচার করতেন। ফলে এতকাল ধরে দেবভাষার সঙ্গে সংস্পর্শহীন থাকায় যে মূল্যবান তথ্য ও তত্ত্বভান্ডার মানুষের অজ্ঞাত থেকে গিয়েছিল, এখন তা আঞ্চলিক ভাষায় প্রচারিত হওয়ায় সকলের বোধগম্য হয়। মানুষের মনে ভারতীয় সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্ম সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল মনোভাব গড়ে ওঠে।
(6) আঞ্চলিক ভাষায় গ্রন্থ রচনা: এ ছাড়া আলোচ্য সময় স্থানীয় ভাষায় বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হতে থাকে। নামদেব, একনাথ প্রমুখ সংস্কারকদের পদাবলি মারাঠি ভাষা ও সাহিত্যকে, কবীরের দোঁহাসমূহ হিন্দিকে, নানকের উপদেশাবলি পাঞ্জাবি ভাষা এবং বঙ্গীয় বৈয়ব কবিদের কাব্য বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। ভক্তিবাদীদের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে আঞ্চলিক ভাষায় প্রাচীন গ্রন্থসমূহ অনূদিত হতে থাকলে মানুষ রামায়ণ, মহাভারত, গীতার সারমর্ম বুঝতে পারে।*
(7) স্বতন্ত্র ধর্মীয় গোষ্ঠী গঠন: ভক্তিবাদী ধর্মাচার্যগণ নিজ মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র ধর্মীয় গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গুরু নানক গঠন করেন শিখ ধর্মীয় গোষ্ঠী। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু গঠন করেন গৌড়ীয় বৈষুব সম্প্রদায়।
মন্তব্য
পরিশেষে বলা যায়, ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতে সামাজিক সাম্য এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। এই আন্দোলন হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধন করেছিল। স্থাণুবৎ ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজব্যবস্থায় এনেছিল এক অভূতপূর্ব গতিশীলতা।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর