বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে নবজাগরণের গুরুত্ব আলোচনা করো
নবজাগরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল বিজ্ঞানচর্চার অগ্রগতি ও বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসমূহ। রেনেসাঁ বা নবজাগরণের প্রভাবে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা, যুক্তি ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চা শুরু হয়। এই সময় প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় অন্ধবিশ্বাস ও ধ্যানধারণাকে চুরমার করে বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিকগণ নতুন নতুন আবিষ্কারের দ্বারা মানুষকে বিস্মিত করে তুলেছিলেন।
বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে নবজাগরণের গুরুত্ব
(1) বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থের প্রকাশ: রেনেসাঁ যুগের মানবতাবাদীগণ প্রাচীন পুথি ও প্রাচীন বিদ্যা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। এই সময় প্রায় তিন হাজার বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে আর্কিমিডিসের প্রবন্ধ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
(2) পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষানিরীক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ: রেনেসাঁ পর্বে বৈজ্ঞানিকগণ প্রকৃতি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলির পরিবর্তে পর্যবেক্ষণ এবং প্রমাণিত তথ্যের উপর বেশি গুরুত্ব দেন। এই পরিবর্তন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(3) প্রাকৃতিক দর্শনের বিকাশ: নবজাগরণের সময়ে প্রাকৃতিক দর্শন বা প্রকৃতির গবেষণা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে, যা ধীরে ধীরে আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে তোলে। এই পর্বে সায়েনসিয়া (Scientia) বলতে বোঝাত সমগ্র জ্ঞানভাণ্ডারকে, আর এই জ্ঞানের বিশেষ বিভাগকে বলা হত প্রাকৃতিক দর্শন যার অন্তর্ভুক্ত ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতিষ, অপরসায়ন, ম্যাজিক, গণিত, জ্যামিতি, শারীরবিদ্যা ইত্যাদি।
(4) ভৌগোলিক আবিষ্কার: নবজাগরণ পর্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি কম্পাস ও এস্ট্রোল্যাবের আবিষ্কার। নৌ-পরিবহণের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেন পাদুয়া, মন্টপিলিয়ের, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপকরা। ফলে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার সহজ হল। স্পেন ও পোর্তুগাল ভৌগোলিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(5) বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্ক ধারণার পরিবর্তন: টলেমির জ্যোতির্বিজ্ঞান, অ্যারিস্টটলের বলবিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত ছিল মধ্যযুগীয় ইউরোপের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ধারণা। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের নতুন বিজ্ঞানচর্চা জীবজগৎ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে প্রচলিত ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটায়। গ্রহ-নক্ষত্র, সৌরজগৎ সম্বন্ধে নতুন ধারণা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন কোপারনিকাস, গ্যালিলিও প্রমুখ বিজ্ঞানী।
(6) মুদ্রণবিপ্লব ও সামরিক বিপ্লব: ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রণ যন্ত্রের আবিষ্কার ইউরোপীয় শিক্ষার জগতে নবদিগন্ত উন্মোচিত করে। এর মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যা নতুন নতুন আবিষ্কারের পথ প্রশস্ত করে। অন্যদিকে সামরিক ক্ষেত্রেও এই সময়ে উন্নত রণনীতি ও সমরাস্ত্রেরও উদ্ভাবন হয়।
মন্তব্য
মূলত মানুষের চিন্তাচেতনার মুক্তির একটি যুগ ছিল নবজাগরণ, যা বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করে পরবর্তীকালে বিজ্ঞান বিপ্লবের পথকে প্রশস্ত করে। বিশ্বাসের আলোকে যুক্তির প্রতিষ্ঠা নয়, যুক্তির মাধ্যমে বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব -এই চিন্তা ছিল নবজাগরণের বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম দান।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর