প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করো
গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে প্লেটো (Plato)-র নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। রাষ্ট্রদর্শন অনুধাবনের বিষয়ে সারা পৃথিবীর কাছে তিনি ছিলেন অন্যতম পথপ্রদর্শক। তাঁর হাত ধরেই রাষ্ট্রচিন্তা প্রথম সমন্বিত রূপ লাভ করে।
প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শন
প্লেটোর শিক্ষাগুরু ছিলেন সক্রেটিস। তাঁর কাছ থেকেই প্লেটো লাভ করেছিলেন রাজনৈতিক জ্ঞানের মূলমন্ত্র- ‘সদ্গুণই হল জ্ঞান’-এর শিক্ষা।
আলোচনা পদ্ধতি
প্লেটো দর্শন আলোচনার কোনও নতুন পদ্ধতি সৃষ্টি করেননি। সংলাপধর্মী (Dialogue) যে বিচারবিশ্লেষণ পদ্ধতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন, তা একান্তভাবেই সক্রেটিসের উদ্ভাবন। প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থ The Republic -এইরূপ সংলাপধর্মী পদ্ধতিতে লেখা হয়েছে। তাছাড়া পিথাগোরাসের (Pythagoras) জ্যামিতিক সূত্র দ্বারাও প্লেটোর আলোচনা পদ্ধতি বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিল। এর পাশাপাশি প্লেটো তাঁর তাত্ত্বিক আলোচনা ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে Deductive Method বা অবরোহ পদ্ধতিও গ্রহণ করেছিলেন।
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে মত
বিশিষ্ট গ্রিক দার্শনিক প্লেটো প্রধানত মানুষের নানা ধরনের প্রয়োজন মেটানোর চাহিদার (মূলত অর্থনৈতিক প্রয়োজনকে পরিতৃপ্ত করার উদ্দেশ্যে) প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের উদ্ভবের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন।
- জীবনের প্রয়োজনবোধ: প্লেটোর মতানুযায়ী, মানুষের জীবনে নানা ধরনের জিনিসের প্রয়োজন হয়, জীবনধারণের জন্য এদের গুরুত্ব অসীম। কিন্তু মানুষ এককভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে তার সব প্রয়োজন মিটিয়ে উঠতে পারে না।
- পারস্পরিকতা: প্লেটোর মতে, দুর্বলতা বা অসম্পূর্ণতা এবং দক্ষতা বা কর্মগুণের পারস্পরিক আদানপ্রদান (Reciprocity) সকলের জীবনের প্রয়োজন মেটাতে পারে। এই আদানপ্রদানভিত্তিক যৌথ জীবনধারার সাংগঠনিক রূপই হল রাষ্ট্র।
ন্যায়বিচার তত্ত্ব
The Republic গ্রন্থে প্লেটো ন্যায়বিচার তত্ত্বের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করেছেন। রাষ্ট্রের ধর্মই হল ন্যায়বিচার তথা সুবিচারের নীতিকে প্রতিফলিত করা- প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শনে এইরূপ নৈতিক বিশ্বাসের পরিচয় মেলে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রচলিত গ্রিক নগররাষ্ট্র এবং সমাজব্যবস্থার মধ্যেই প্লেটো ন্যায়বিচারের অনুসন্ধানে সচেষ্ট হয়েছেন।
আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা
বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তাবিদ প্লেটো কল্পনা করেছিলেন ন্যায়নির্ভর এক আদর্শ রাষ্ট্রের। দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা তুলে ধরে তিনি বলেছেন যে, আদর্শ রাষ্ট্রের সকল সদস্য নিজেকে এক বৃহৎ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করবে। এইরূপ রাষ্ট্রীয় পরিবারের মধ্যে সমষ্টিগত জীবনযাপনকে প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তি বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও দেখিয়েছেন যে, উৎপাদক, যোদ্ধা এবং শাসক বা অভিভাবক এই তিনটি শ্রেণির একত্রে অবস্থান এবং তাদের নিজ নিজ কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে আদর্শ রাষ্ট্রের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে। এই তিন শ্রেণির কয়েকটি নৈতিক গুণ থাকা অবশ্যপ্রয়োজনীয় বলে প্লেটো মনে করতেন, যথা- মহত্ত্ব বা প্রজ্ঞা (wisdom), মিতাচার (temperance), সাহস (courage), ন্যায়পরায়ণতা (justice)।
শিক্ষাতত্ত্ব
ন্যায়নির্ভর ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এক উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার সন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ প্লেটো। তাঁর The Rupublic গ্রন্থের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও বিশেষভাবে সপ্তম অধ্যায়ে শিক্ষাতত্ত্ব বিষয়ে আলোচনা উপস্থিত। আদর্শ রাষ্ট্রে শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ শ্রেণির প্রাধান্য বা বংশভিত্তিক শিক্ষার বদলে রাষ্ট্রের প্রতিটি শিশুকে সর্বোচ্চ শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়। তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করার কথা বলেন। প্রথম স্তরে যারা শিক্ষালাভ করবেন এবং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবেন তারা উৎপাদক শ্রেণিভুক্ত হবেন। দ্বিতীয় স্তরে যারা অকৃতকার্য হবেন তারা সেনাবাহিনীতে যোগদান করবেন এবং তৃতীয় অর্থাৎ সর্বোচ্চ স্তরে যারা সাফল্য লাভ করবেন, তারা শাসক হিসেবে পরিচিত হবেন- বিশেষত দার্শনিক শাসকরূপে তারা উন্নীত হবেন।
- প্রাথমিক শিক্ষা: প্রাথমিক শিক্ষার ২টি স্তর প্লেটোর শিক্ষাতত্ত্বে লক্ষণীয়, প্রথমটি হল ৬ বছর পর্যন্ত এবং দ্বিতীয়টি ১৮ বছর পর্যন্ত। এই পর্বে মূলত কল্পনাশক্তির বিকাশসাধনের জন্য শিক্ষাদান করা হবে বলে উল্লিখিত হয়।
- উচ্চতর শিক্ষা: উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও প্লেটো ১৮ ৫০ বছর পর্যন্ত বয়সিদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটানোর জন্য শিক্ষাকে বিভিন্ন স্তরে বিভাজিত করে আদর্শ রাষ্ট্রের উপযুক্ত শিক্ষাপ্রণালীর নকশা প্রস্তুত করেছেন। প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের একজন আদর্শ নাগরিক হওয়ার জন্য কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও প্রশিক্ষণের উপর জোর দিয়েছেন। শিক্ষার প্রতিটি স্তর অতিক্রমের পর সর্বশেষ স্তরে লোভ ও দুর্নীতি থেকে তারা কতটা মুক্ত হতে পেরেছে তার পরীক্ষা নেওয়া হয়। এই স্তরটিতে উত্তীর্ণ হওয়া ব্যক্তিগণ শাসক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন বলে প্লেটো অভিমত প্রকাশ করেছেন।
সাম্যবাদী তত্ত্ব
ন্যায়নীতির ভিত্তিতে প্লেটো যে আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার মডেল উপস্থাপন করেছেন তাতে মূলত শাসক শ্রেণির জন্য একপ্রকার সাম্যবাদের আদর্শ সংযোজিত করা হয়েছে। বস্তুতপক্ষে প্লেটোর লক্ষ্য ছিল- শাসক শ্রেণির জীবনধারাকে এক সমভোগবাদী আদর্শে চালিত করা। এমনকি পারিবারিক জীবনেও তিনি সমভোগবাদের কথা বলেছেন।
প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শন সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। তা সত্ত্বেও একথা বলা যায় যে রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর ভাবনার গভীরতা এবং ব্যাপকতা নিঃসন্দেহে ভাবীকালের জন্য শিক্ষণীয়। শাসকের নৈতিক আচরণ, রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তির ক্ষুদ্র স্বার্থের বিসর্জন ইত্যাদি আধুনিক কল্যাণকামী রাষ্ট্রব্যবস্থা রূপায়ণের কাজে পথপ্রদর্শকের কাজ করবে।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর