প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্বটি বিশ্লেষণ করো
প্লেটোর ন্যায়বিচার তত্ত্ব
প্লেটোর রাষ্ট্রদর্শনের মূল কথাই হল ন্যায়বিচার (Justice)। প্লেটোর আবির্ভাবকালে গৃহযুদ্ধে জর্জরিত এথেন্সের রাজনৈতিক জীবনে সৃষ্টি হয়েছিল এক গভীর সংকট। সক্রেটিসের অনুগামী প্লেটো তাঁর শিক্ষকের মতোই এই সংকটের কারণ ও তা নিরসনের উপায় অনুসন্ধানে ব্রতী হন। এথেন্সের সম্ভ্রান্ত নাগরিক সেফেলাস (Cephalus), তাঁর পুত্র পলিমার্কাস (Polemarchus), সফিস্ট দার্শনিক থ্রেসিমেকাস (Thrasymachus) প্রমুখের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে প্লেটো তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার মূলকথা ন্যায়বিচার তত্ত্ব (Theory of Justice) উপস্থাপন করেন।
The Republic গ্রন্থে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে উত্থাপিত স্থানীয় মতামতগুলির (Representative Opinion) গ্রহণ বা খণ্ডনের দ্বারা প্লেটো তাঁর ন্যায়বিচার তত্ত্ব রূপায়িত করেন। বস্তুতপক্ষে সফিস্টদের সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চিন্তার বর্জনের দ্বারা প্লেটো এক সমষ্টিবাদী রাষ্ট্র ও সমাজদর্শন উপস্থাপিত করেছিলেন। তাঁর মতানুসারে, ন্যায়নীতি হল প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তি তথা আত্মার সদ্গুণ যার জোরেই কোনও মানুষ তার ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়ন্ত্রণে রেখে সাধারণের কল্যাণমূলক কর্মে উদ্যোগী হবে। গ্রিক নগররাষ্ট্র এবং প্রচলিত সমাজব্যবস্থার মধ্যেই প্লেটো ন্যায়ের বিভিন্ন দিকগুলির অনুসন্ধান করেছেন।
(i) সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সমস্যা হিসেবে ন্যায়বিচার
ন্যায়বিচার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে নৈতিক সমস্যা হিসেবেই আলোচিত হয়েছে। কিন্তু প্লেটো একটি সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সমস্যা হিসেবে ন্যায়বিচারের ধারণা গড়ে তুলতে চেয়েছেন।
(ii) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
আত্মতুষ্টি, স্বার্থপূরণ, সংশয় বা সন্দেহ ন্যায়তত্ত্বের প্রতিবন্ধক। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সুষ্ঠু বিন্যাসের দ্বারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
(iii) জনসমাজের সাংগঠনিক ব্যবস্থার অংশরূপে ন্যায়
ন্যায় হল ব্যক্তিসমূহের সম্পর্ক (relation among individuals)। এই বিষয়টি ব্যক্তিগত আচরণ হিসেবে নয়, জনসমাজের সাংগঠনিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে উপলব্ধি করা সম্ভব।
(iv) ন্যায়-এর সন্ধান
প্লেটোর মতে, ব্যক্তিস্বার্থ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বৃহত্তর সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে ন্যায়ের সন্ধান করা সম্ভব।
(v) নাগরিকদের স্বার্থে শাসকের ন্যায়বিচার
শাসকের গুণ হবে নাগরিকদের সর্বাধিক কল্যাণসাধন করা। নাগরিকদের স্বার্থে শাসকের নিজেকে নিঃস্বার্থভাবে নিয়োজিত করার মানদণ্ডে তাঁর ন্যায়বিচারের গভীরতা বিচার করা দরকার।
(vi) শাসকের মহত্ব
প্লেটো আরও বলেছেন, যে শাসক সামাজিক কল্যাণের স্বার্থে শাসন করেন তিনিই মহৎ। এই মহত্ব যথার্থ শাসকের গুণ ও শক্তির আধার।
(vii) ন্যায়পরায়ণ শাসকের কাজ
সঠিকভাবে শোনা যেমন কানের কাজ, সঠিকভাবে দেখা যেমন চোখের কাজ, তেমনই সমাজের জন্য সুখী ও সুন্দর জীবনের অনুসন্ধান করা ন্যায়পরায়ণ শাসকের কাজ।
(viii) ন্যায়ের স্বরূপ সন্ধান
প্লেটো মনে করেন, ন্যায়নীতি কোনও আরোপিত গুণ নয়। তাঁর সমকালীন পণ্ডিত ও বন্ধু গ্লুকন (Glucon) মনে করতেন যে, মানুষ তাৎক্ষণিক বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সাময়িক বোঝাপড়া করে ‘ন্যায়’-কে গ্রহণ করে। প্লেটো এই মতের বিরোধিতা করেন। তাঁর মতানুসারে, ন্যায়বোধ কোনও বাহ্যবস্তু নয়। অন্তরের গভীরে তার অবস্থান। মানুষের মনকে বিচারবিশ্লেষণ করলে ন্যায়ের স্বরূপ সন্ধান করা যাবে।
(ix) আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা
ন্যায়বিচার তত্ত্বের প্রেক্ষাপটে প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রকে কল্পনা করেছেন। মানুষের মধ্যে ন্যায়ের উপস্থিতি বোঝাতে তিনি আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, একটি যৌথজীবন বা রাষ্ট্রের মধ্যে মানুষের প্রয়োজন ও প্রতিভার পূর্ণতা আসে। তাই ন্যায়বিচার তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে প্লেটো রাষ্ট্রের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছেন।
(x) ন্যায়নীতির ধারণা
প্লেটোর মতে, ন্যায়নীতি হল একটি সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তিস্বরূপ (Justice is the order)। এই ন্যায় (Justice) রাষ্ট্রদেহের আত্মাস্বরূপ (Soul)। একটি দেহস্বরূপ রাষ্ট্র ন্যায়নীতি দ্বারা চালিত হলেই তা স্থির ও স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলতে সক্ষম হয়। তাঁর মতে, ন্যায়বিচার হল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় এককগুলির মধ্যে সমন্বয়মূলক কর্মের রূপায়ণ (Harmonious Functioning)। এর ভিত্তিতে আরও বলা যায় যে, নগররাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রীয় সমাজের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এককগুলি যখন সমন্বয়মূলক কাজে লিপ্ত থাকবে তখনই প্রস্ফুটিত হবে আদর্শ রাষ্ট্রের ছকটি।
মূল্যায়ন
অনেক রাষ্ট্রচিন্তকদের কাছে প্লেটোর ন্যায়নীতির তত্ত্ব প্রশংসিত হলেও বহু সমালোচকগণ এর নানান সমালোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, এই তত্ত্বে ব্যক্তিমানুষের অন্তর্নিহিত বৈচিত্র্যের আবেদনকে কোনোভাবেই গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। স্যাবাইন (Sabine)-এর বক্তব্য অনুযায়ী, ন্যায়বিচারকে সামনে রেখে প্লেটো, শাসক শ্রেণির আধিপত্য এবং বৈষম্যমূলক সামাজিক শ্রেণিবিভাজনকেই মান্যতা দিতে চেয়েছেন। কার্ল পপার (Karl Popper)-এর মতো আধুনিক দার্শনিকও প্লেটোর ন্যায়নীতির তত্ত্বকে একটি সামগ্রিকতাবাদী তত্ত্বরূপে বর্ণনা করে প্লেটোকে সর্বাত্মক রাষ্ট্রের প্রবক্তা বলে নিন্দা করেছেন।
তবে নানান সমালোচনা সত্ত্বেও একথা বলা যায় রাষ্ট্রচিন্তার জগতে প্লেটোর এই তত্ত্বের গুরুত্ব ব্যাপক। একটি আদর্শ রাষ্ট্রে ন্যায়বিচারের চরিত্র কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে গভীর ও ব্যাপক অনুসন্ধানের পর তিনি ন্যায়বিচারের তত্ত্বের উপস্থাপন করেছেন। বার্কি (Berki) প্লেটোর ন্যায়বিচারের ধারণাকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ন্যায়নীতি বা ন্যায়বিচার সম্পর্কে প্লেটোর নিজের ব্যাখ্যা অনুযায়ী বলা যায় যে, ন্যায়বিচার হল মানুষের অন্তরের সঙ্গে সম্পর্কিত। তার নিজের অন্তর বা মনকে বিশ্লেষণ করলেই সে এর সঠিক সন্ধানে সক্ষম হবে।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর