প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাটি বিশ্লেষণ করো
প্লেটোর কল্পিত আদর্শ রাষ্ট্র কেবলমাত্র কল্পনা নয়। এটি ছিল তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার ও গভীর গবেষণার ফসল।
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র এর ধারণা
মানবজীবনে পারস্পরিকতার (Reciprocity) প্রেক্ষিতে প্লেটো একটি আদর্শ রাষ্ট্রের গুণাবলি ও কর্তব্যকর্ম তাঁর The Republic গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন। এই রাষ্ট্রদর্শনে ঐক্য এবং সংহতির (Unity) উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে কতগুলি বিষয়ের কথা বলা যায়- প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র ব্যক্তিজীবনের বর্ধিত সংস্করণ, নয় এবং ব্যক্তি রাষ্ট্রজীবনের অংশমাত্র, ধারণার অস্তিত্ব আছে, এই রাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ স্বীকৃত আদর্শ রাষ্ট্রে একধরনের সাম্যবাদী সক্রেটিসের সদ্গুণই হল জ্ঞান (Knowledge is Virtue)- এই তত্ত্বের রূপায়ণের প্রয়াস ছিল প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র।
(i) বৃহৎ পরিবারমনস্কতা
প্লেটোর মতে, আদর্শ রাষ্ট্রের সমাজভুক্ত সকল সদস্য নিজেকে এক বৃহৎ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করবে। ব্যক্তিগত পরিবার (জন্মগত সম্পর্কভুক্ত) নয়, রাষ্ট্রীয় পরিবারের মধ্যে সমষ্টিগত জীবনযাপনকে প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তি বলে চিহ্নিত করেছেন।
(ii) তিনটি শ্রেণির সহাবস্থান
প্লেটো উল্লেখ করেছেন যে, মানুষের আবশ্যিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য আদর্শ রাষ্ট্রে তিনটি শ্রেণির সহাবস্থান থাকবে। এই তিনটি শ্রেণি হল- উৎপাদক শ্রেণি (Artisan class), যোদ্ধা শ্রেণি (Warrior class) এবং শাসক বা অভিভাবক শ্রেণি (Guardian class)। এই তিনটি শ্রেণি যথাক্রমে মিতাচার, সাহসিকতা এবং প্রজ্ঞাগুণের অধিকারী হবেন।
- (a) উৎপাদক শ্রেণি: প্লেটোর চিন্তা অনুযায়ী, আদর্শ রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হবে মানুষের প্রাত্যহিক চাহিদা পূরণ করা। এই লক্ষ্যে আদর্শরাষ্ট্র কৃষক, কারিগর, হস্তশিল্পী-সহ বিভিন্ন দক্ষ মানুষদের নানান উৎপাদনমূলক কাজে নিয়োজিত করবে। উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত সকল ব্যক্তি যারা সম্পদ সৃষ্টিতে বিশেষভাবে সাহায্য করে তারা এই উৎপাদক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
- (b) যোদ্ধা শ্রেণি: মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে আদর্শ রাষ্ট্র একটি সেনা সংগঠন বা যোদ্ধাবাহিনী পোষণ করবে বলে তিনি মনে করেন।
- (c) শাসক বা অভিভাবক শ্রেণি: একটি আদর্শ রাষ্ট্রের শাসনদায়িত্ব পালন করবেন একজন দার্শনিক রাজা (Philosopher King)। তিনি হবেন রাষ্ট্রের অভিভাবক। প্রজাদের রক্ষণাবেক্ষণ ও তাদের জীবনের মানোন্নয়ন করা শাসকের অন্যতম প্রধান কাজ। মেধা, জ্ঞানসম্পন্ন এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষিত শাসকের পক্ষেই আদর্শ রাষ্ট্র রূপায়ণ করা সম্ভব। এই গুণাবলিকে প্লেটো বলেছেন দার্শনিক উপাদান (Philosophic Element)
(iii) চারটি আবশ্যিক গুণ
প্লেটো উপরোক্ত তিনটি শ্রেণির সাফল্যের জন্য নৈতিক গুণাবলির কথা বলেছেন। এগুলি হল- মহত্ত্ব বা প্রজ্ঞা (Wisdom), মিতাচার (Temperance), সাহস (Courage) এবং ন্যায়পরায়ণতা (Justice)।
- (a) মহত্ব বা প্রজ্ঞা: প্লেটোর মতে, শাসক অবশ্যই মহত্ত্ব বা প্রজ্ঞার অধিকারী হবেন। এই গুণ রাজাকে প্রজাসাধারণ ও রাষ্ট্রের যথার্থ মঙ্গল ও অগ্রগতির পথ নির্দেশ করবে।
- (b) সাহসিকতা: আবার যোদ্ধাদের প্রধান গুণ হবে সাহসিকতা।
- (c) মিতাচার: এর পাশাপাশি তিনটি শ্রেণিই হবে মিতাচার গুণের অধিকারী। এই গুণ তাদের সহনশীল করবে। প্লেটোর মতে, মিতাচার গুণ উৎপাদক শ্রেণির ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ, এই গুণ তাদের হিংসা, ঈর্ষা, অন্যের ক্ষতি করার ইচ্ছা থেকে মুক্ত রাখবে।
- (d) ন্যায়পরায়ণতা: ন্যায়বিচার বা ন্যায়পরায়ণতা গুণ হবে সর্বজনীন। প্রত্যেকটি শ্রেণির নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যপালনের আন্তরিক প্রয়াসই হল ন্যায়বিচার।
(iv) কল্যাণকামী দৃষ্টিভঙ্গি
প্লেটোর মতানুযায়ী আদর্শ রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি হবে কল্যাণকামী। দার্শনিক রাজা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনকল্যাণের কাজে নিয়োজিত থাকবেন। প্লেটো মনে করেন যে, দার্শনিক রাজা ছাড়া আদর্শ রাষ্ট্রের রূপায়ণ সম্ভব হবে না। এই রাজ্যে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে প্রভেদ থাকবে না। সুষ্ঠু শিক্ষার প্রবর্তন দ্বারা নাগরিকদের সৎ ও নৈতিক গুণাবলির অধিকারী করে তোলাই হবে রাজার লক্ষ্য। *2
(v) ন্যায়বিচারের অবস্থান
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তি হল ন্যায়নীতি সক্রিয়তা। ন্যায়নীতি হল একটি শৃঙ্খল, যা সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্ত রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তিস্বরূপ। এই ‘ন্যায়’ হল রাষ্ট্রদেহের ‘আত্মা’। একটি আদর্শ রাষ্ট্র ন্যায়নীতি বা ন্যায়বিচারের পথ অনুসরণ করে সুখ, শান্তি ও প্রগতির অধিকারী হতে পারে।
(vi) আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা
বিশিষ্ট দার্শনিক প্লেটো ন্যায়নির্ভর ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার অনুসন্ধান করেছেন। বস্তুত, রাষ্ট্রের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন, বাধ্যতামূলক ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষায় সকলের সুযোগপ্রাপ্তি- প্লেটোর শিক্ষাতত্ত্বের এই দিকগুলি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
(vii) সাম্যবাদী চিন্তা
ন্যায়নীতির ভিত্তিতে প্লেটো যে আদর্শ রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার মডেল তুলে ধরেছেন সেখানে মূলত শাসক শ্রেণির জন্য সাম্যবাদের আদর্শের সংযোজন ঘটেছে। আসলে তাঁর লক্ষ্য ছিল শাসক শ্রেণির জীবনধারাকে একটি সমভোগবাদী আদর্শে চালিত করা।
মূল্যায়ন
প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। সমালোচকরা অনেকেই প্লেটোর এই রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে কল্পনার আধিক্য বেশি বলে মনে করেন। আবার অনেকের মতে, প্লেটো এমন একটি রাষ্ট্রের রূপরেখা এঁকেছেন যেখানে ব্যক্তিস্বার্থ বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই। এমনকি একথা অনেকে মনে করেন, প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রে যে সাম্যবাদের কথা বলেছেন তা ছিল মানবপ্রকৃতি বিরোধী, অস্বাভাবিক ও ভ্রান্ত। এসকল নানান সমালোচনা সত্ত্বেও বলা যায় যে, প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা প্রকাশ করেছিলেন গ্রিক নগররাষ্ট্রের সংকটকালে এবং এর মূল লক্ষ্যই ছিল এথেন্সের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনা। তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা পরবর্তীকালের দার্শনিকদেরও বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর