ন্যায়ের প্রকৃতি নির্ণয় করো

ন্যায়ের প্রকৃতি নির্ণয় করো

ন্যায়ের প্রকৃতি নির্ণয় করো
ন্যায়ের প্রকৃতি নির্ণয় করো

ন্যায়ের প্রকৃতি

রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ন্যায়ের মাধ্যমে কোনো সমাজের ভালো বা মন্দ বোঝা যায়। ন্যায়ের অস্তিত্বের ওপর সামাজিক উৎকর্ষ নির্ভরশীল। ন্যায়ের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। যেসব দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যায়ের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে, সেগুলি হল— [1] সাবেকি উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণ, [2] নয়া উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণ এবং [3] মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ।

[1] সাবেকি উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণ:

i. বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ ও কর্তব্যপালন: প্রাচীন গ্রিক রাষ্ট্রচিন্তায় ন্যায়ের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে প্লেটো তাঁর ‘The Republic’ গ্রন্থে কয়েকটি আদর্শ মতামতকে তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, ব্যক্তিস্বার্থের দ্বারা নয়, বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ ও কর্তব্যপালনের মধ্য দিয়ে ন্যায়ের সন্ধান করা যেতে পারে। প্লেটো মনে করতেন, সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হলে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তাঁর অভিমত ছিল, অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করে প্রত্যেকে নিজের যোগ্যতা অনুসারে কর্তব্য পালন করলে এই সমন্বয় বজায় রাখা যায়।

ii. সামাজিক বাস্তবতা: ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর্নেস্ট বার্কার উদারনীতিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যায়ের প্রকৃতির বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বার্কারের মতে, ন্যায়ের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করার আগে তার উৎস সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। ন্যায়ের চারটি প্রধান উৎস রয়েছে সেগুলি হল-① ধর্ম, ② প্রকৃতি, ও অর্থনীতি এবং ④ নীতিশাস্ত্র। এক্ষেত্রে উৎস হিসেবে নীতিশাস্ত্রকে বার্কার সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন। তিনি মনে করেন, ন্যায় যদিও নৈতিকতা নয়, তবুও তা নৈতিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। ন্যায় সম্পর্কিত নিয়মাবলি চূড়ান্তভাবে নীতিশাস্ত্র থেকে উদ্ভূত। বার্কারের, মতে, ন্যায় কোনো তত্ত্বগত বিমূর্ত ধারণা নয়। ন্যায় হল একটি সামাজিক বাস্তবতা (‘a social reality’)। তাঁর মতে, ন্যায়ের ধারণা প্রত্যেকের মধ্যে বিরাজ করছে। বার্কারের মতে, রাষ্ট্রের সাহায্যে মানব-সম্পর্ককে সুবিন্যস্ত করার নীতি হল ন্যায়। এই কারণে ন্যায়ের শাসন অক্ষুণ্ণ রাখা রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য। ন্যায়ভিত্তিক সমাজের স্বার্থে রাষ্ট্রীয় আইনকে মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত করা দরকার বলে তিনি মনে করতেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে ন্যায়ের শাসন বজায় থাকলে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের মহোত্তম বিকাশসাধন সম্ভব।

III. সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ: দার্শনিক বেন্থাম ন্যায় প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রকে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণের নীতি গ্রহণের পরামর্শ দেন।

[2] নয়া উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণ:

সমান স্বাধীনতা, সমান সুযোগসুবিধা, বিশেষ অধিকার: নয়া উদারনীতিবাদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা জন রল্স 1971 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘A Theory of Justice’ গ্রন্থে ন্যায়ের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এক নতুন ধারণার অবতারণা করেন। তিনি ন্যায়কে ক্ষমতা, সুযোগসুবিধা, অধিকার, স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা, আয় ও সম্পদের মতো ‘প্রাথমিক সামগ্রী’র ন্যায্য বণ্টন বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে, সমবণ্টন হল ন্যায়ের প্রধান উৎস। এজন্য তিনটি মূলনীতির কথা রল্স উল্লেখ করেন। সেগুলি হল- (i) প্রতিটি ব্যক্তির সমান স্বাধীনতা লাভের অধিকার, (ii) চাকরি ও মর্যাদালাভের ক্ষেত্রে সকলের সমান সুযোগসুবিধা, (iii) ন্যায়ের স্বার্থে সামাজিকভাবে দুর্বলতর ব্যক্তি বা শ্রেণির জন্য বিশেষ অধিকার বা বিশেষ ব্যবস্থার সংস্থান। এই শেষোক্ত নীতিটি গ্রহণের ফলে সামাজিকভাবে অনগ্রসর ও দুর্বলতর জনগোষ্ঠীর লোকেরা অন্যদের সঙ্গে একই সারিতে উন্নীত হতে পারবে। রসের বক্তব্য হল, সংখ্যাগরিষ্ঠের কল্যাণ নয়, সমস্ত মানুষের কল্যাণই ন্যায়ের উদ্দেশ্য। এই কারণে দুর্বলতর শ্রেণির জন্য বিশেষ সুযোগসুবিধার ব্যবস্থাকে তিনি ন্যায়ের অঙ্গ বলেছিল। নয়া উদারনীতিবাদী তাত্ত্বিক রবার্ট নোজিক ন্যায়-সম্পর্কিত রসের এই তত্ত্বের সমালোচনা করেন। নোজিকের মতে, সৎ উপায়ে অর্জিত বা উত্তরাধিকারসূত্রে বা হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রাপ্ত সম্পত্তির ওপর ব্যক্তির ন্যায়সংগত অধিকার রয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো বঞ্চনা ন্যায় প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে তিনি মনে করেন।

[3] মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ:

মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্যযুক্ত সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। মার্কসবাদীরা ন্যায় বলতে অর্থনৈতিক ন্যায়কে বোঝান। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে তাঁরা মনে করেন।

মন্তব্য: ন্যায়ের প্রকৃতি মানবসভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। তাই এ কথা বলা যায় যে, ন্যায়ের প্রকৃতি পরিবর্তনশীল।

আরও পড়ুন – রাজনৈতিক তত্ত্বের মূল ধারণাসমূহ ২ নম্বরের প্রশ্ন ও উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment