ধর্মসংস্কার আন্দোলনের বিকাশে জন ক্যালভিনের ভূমিকা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো
প্রোটেস্ট্যান্টবাদের প্রবর্তক মার্টিন লুথার হলেও এই ধর্মের প্রচার ও প্রসারের কাজে জন ক্যালভিন (John Calvin, ১৫০৯-১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দ)-এর বিশেষ অবদান রয়েছে। তাঁর মতাদর্শ ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পরবর্তী প্রায় দুশো বছর পর্যন্ত টিকেছিল।
ধর্মসংস্কার আন্দোলনের বিকাশে জন ক্যালভিনের ভূমিকা
(1) প্রথম জীবন: অধ্যাত্ম ও আইনবিদ্যায় গভীর ব্যুৎপত্তির অধিকারী জন ক্যালভিন-এর জন্ম হয় প্যারিসের নিকটবর্তী নোয়ন (Noyon) শহরে। ধ্রুপদি সাহিত্য, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ এবং সন্তদের জীবনী পড়ে তিনি চার্চের সংস্কার করার কথা চিন্তা করেন। অবশ্য ক্যাথলিকদের ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে তিনি ফ্রান্সে তাঁর মতবাদ প্রচার করতে পারেননি। দেশত্যাগ করে ক্যালভিন সুইটজারল্যান্ডে চলে যান এবং জেনেভা শহরকে কেন্দ্র করে ধর্মপ্রচারের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
(2) মতাদর্শ : জন ক্যালভিন ছিলেন সহজ-সরল জীবনাদর্শে বিশ্বাসী। তিনি তৎকালীন চার্চ ও যাজকতন্ত্রের দুর্নীতির বিরোধিতা করে খ্রিস্টান ধর্মকে পূর্বের পবিত্রতার সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করেছিলেন। তিনি পূর্ব-নির্ধারণবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি প্রাথমিক পর্বে ঈশ্বরের আশীর্বাদে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধিতার পক্ষপাতী না হলেও পরবর্তীতে এই মতের কিছু সংশোধন করেন।
(3) পুস্তিকা প্রকাশ: ১৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ক্যালভিনের সাড়া জাগানো গ্রন্থ Institutes of the Christian Religion. এই গ্রন্থে তাঁর রোমান চার্চব্যবস্থার সংস্রববর্জিত একটি বিকল্প ধর্মসংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য, প্রকৃতি ও কর্মধারার বর্ণনা করা হয়েছে। ক্যালভিন রচিত এই গ্রন্থটি ছিল প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমতের পক্ষে এক জোরালো সওয়াল। ক্যালভিনের ইনস্টিটিউটস গ্রন্থে প্রকাশিত তাঁর বক্তব্যসমূহ ছিল A True Theory of State. এই গ্রন্থটি তিনি ফরাসিরাজ ফ্রান্সিসকে উৎসর্গ করেন। পুস্তকটি একদিকে ছিল ক্যাথলিক পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ এবং অন্যদিকে রাজা ফ্রান্সিসের প্রতি কিছু উপদেশ। যাজক শ্রেণির মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা ছাড়া যে ধর্মচর্চা করা সম্ভব নয়, ক্যাথলিকদের এই প্রচার যে ভ্রান্ত, সেকথা ক্যালভিন প্রমাণ করেছিলেন।
(4) চার্চব্যবস্থার পুনর্গঠন: চার্চব্যবস্থার পুনর্গঠন প্রসঙ্গে ক্যালভিন বলেন যে, চার্চ পরিচালনার দায়িত্ব ও অধিকার কেবলমাত্র যাজকদের থাকবে না। এই দায়িত্ব ৫ জন যাজক এবং ১২ জন অযাজক খ্রিস্টানদের নির্বাচিত সভার হাতে দেওয়ার কথা বলেন। শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে যাজকরা অভিযুক্ত হলে ক্যালভিন তাঁদের কঠোর শাস্তিপ্রদানের ব্যবস্থাও করতেন।
(5) বাইবেলের গুরুত্ব প্রচার: বাইবেলের উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করে ক্যালভিন বাইবেলের আইনকে ‘রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বোচ্চ আইন’ বলে মনে করতেন। আলোচ্য কালপর্বে ক্যালভিন ও তাঁর সহযোগীরা একলেজিয়াসটিক্যাল অর্ডিন্যান্স (Ecclesiastical Ordinances, ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দ) বা ধর্মীয় অধ্যাদেশ দ্বারা চার্চ ও রাষ্ট্রপরিচালনার ব্যবস্থা করেন। এদিক থেকে বিচার করলে জন ক্যালভিনকে চার্চব্যবস্থার সংগঠনে গণতন্ত্রের প্রবর্তক বলে অভিহিত করা যায়।
(6) আদর্শ চার্চ-রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন: জন ক্যালভিন জেনেভাতে আদর্শ চার্চ-রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করেছিলেন, যার ছিল দুটি শাখা- কাউন্সিল অফ মিনিস্টারস (Council of Ministers) এবং কনসিসটোরি (Consistory)। ক্যালভিনের আদর্শ চার্চ-রাষ্ট্রব্যবস্থার দুই শাখা নিয়ে তিনি যে সুপ্রিম কাউন্সিল (Supreme Council) গঠন করেছিলেন, সেই কাউন্সিলই চার্চ ও রাষ্ট্রপরিচালনার অধিকার লাভ করেছিল। এই ধরনের চার্চ-রাষ্ট্র জুরিখ ও বার্নে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
(7) ক্যালভিনের মতাদর্শের প্রসার: জন ক্যালভিনের ব্যক্তিগত আচার- আচরণ ও বক্তব্য খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করে। ফলে প্রোটেস্ট্যান্টবাদ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর অনুগামীরা ফ্রান্সে হিউগেনট (Huguenots), ইংল্যান্ডে পিউরিটান (Puritans) এবং স্কটল্যান্ডে প্রেসবিটারিয়ান (Presbyterians) নামে পরিচিত হয়।
মূল্যায়ন
সবশেষে বলা যায় যে, ক্যালভিনের মতবাদ নিছকই বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজনৈতিক মহল এবং অর্থনীতির উপরেও এর প্রভাব অনুভূত হয়েছিল। যদিও সামাজিক বিষয়ে ক্যালভিনপন্থীরা বেশ খানিকটা রক্ষণশীল ছিলেন, অথবা অন্যান্য সংস্কারকদের মতো ক্যালভিনকেও খানিকটা স্ববিরোধিতা স্পর্শ করেছিল, তবুও ইউরোপীয় ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পটভূমিকায় এই মতাদর্শের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর