টমাস হবসের রাষ্ট্রদর্শন সম্পর্কে আলোচনা করো
অথবা, আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে টমাস হবসের রাষ্ট্রচিন্তার মূল বক্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা, হবসের রাষ্ট্রচিন্তার ধারাগুলির মূল্যায়ন করো।
টমাস হবসের রাষ্ট্রদর্শন
সামাজিক চুক্তি মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা টমাস হবস (Thomas Hobbes) ছিলেন একজন বিশিষ্ট ইংরেজ রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। Leviathan গ্রন্থের মধ্য দিয়ে হবস সামাজিক চুক্তি মতবাদের প্রেক্ষাপটে রাজতন্ত্র বজায় রাখার কথা বলেছেন। হবসের রাষ্ট্রদর্শনের মূল বিষয়গুলি হল-
(i) প্রকৃতির রাজ্য ও মানবপ্রকৃতি: হবস বলেছেন, রাষ্ট্রগঠনের আগে মানুষ প্রাক্-সামাজিক এক প্রকৃতির রাজ্যে (State of Nature) বসবাস করত। এখানে সামাজিক জীবনের প্রতি মানুষের ঝোঁক ছিল না। এরূপ প্রাক্-সামাজিক অবস্থায় চরিত্রগতভাবে Leviathan গ্রন্থের প্রচ্ছদ মানুষ ছিল স্বাধীন, হিংস্র, আত্মকেন্দ্রিক, ক্ষমতালিঙ্গু ও স্বেচ্ছাচারী। কোনও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা কোনও নিয়ন্ত্রণ সেই সময় ছিল না। তারা একে অপরকে নিজেদের শত্রু বলে মনে করত। অভিন্ন বাসনা পরিতৃপ্তির জন্য নির্দয় প্রতিযোগিতা, একে অপরকে ক্ষমতায় ছাপিয়ে যাওয়ার ভয় এবং সর্বোপরি ক্ষমতা বৃদ্ধির অদম্য আকাঙ্ক্ষার দরুন মানুষে মানুষে তীব্র বিরোধ ও হানাহানি শুরু হয়। এই অবস্থাকেই হবস ‘প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের লড়াই’ (War of every man against every man) বলে উল্লেখ করেছেন। এই নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনের কোনও নিরাপত্তা ছিল না। মানুষের জীবন ছিল নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, ঘৃণ্য, পাশবিক ও স্বল্পায়ু।
(ii) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা: প্রকৃতির রাজ্যের নৈরাজ্য থেকে মানুষ তার স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি ও আত্মরক্ষার প্রাকৃতিক নিয়মেই বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। প্রকৃতির রাজ্যের মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা ও স্থায়ী শান্তির জন্য এক সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের সমস্ত ক্ষমতা ও স্বাধীনতা এক সর্বশক্তিমান ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদের হাতে অর্পণ করে দেয়। বিনিময়ে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদ মানুষের নিরাপত্তা, শান্তি ও জীবনের সুরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এইভাবে প্রকৃতির রাজ্যের অবসান ঘটে ও সৃষ্টি হয় চূড়ান্ত ক্ষমতাসম্পন্ন সার্বভৌম রাষ্ট্রের।
(iii) সামাজিক চুক্তি মতবাদ: হবসের তত্ত্বে রাষ্ট্রগঠনের পন্থা হিসেবে উঠে এসেছে সামাজিক চুক্তির প্রসঙ্গটি। বস্তুতপক্ষে, মানুষ প্রকৃতির রাজ্যের বিশৃঙ্খল ও অরাজক অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য পরস্পরের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির দরুন সৃষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদ, তথা সার্বভৌম শক্তির হাতে মানুষ সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং অকুণ্ঠ আনুগত্য সমর্পণ করে। হবসের মতে, এই সামাজিক চুক্তি Jus Naturale অর্থাৎ, স্বাধীনতার রাজ্য (নিজের খুশি ও ক্ষমতা অনুযায়ী চলার পরিবেশ) থেকে মানুষকে পৌঁছে দেয় Lex Naturalis অর্থাৎ, আইনের রাজ্যে বা যুক্তি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নিয়মের রাজ্যে।
(iv) রাষ্ট্রের প্রকৃতি: মানুষের মধ্যে চুক্তির দরুন, বহু মানুষের একক সত্তায় মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে রাষ্ট্র বা কমনওয়েলথ, যাকে হবস বলেছেন Leviathan বা রাষ্ট্রদানব। এই রাষ্ট্র প্রকৃতিসৃষ্ট স্বাভাবিক দেহ নয়, মানব কর্তৃক সৃষ্ট একটি কৃত্রিম মানুষ, তথা একক ব্যক্তিত্ব। হবস বলেন যে, এই রাষ্ট্রদানব তথা অতিকায় সর্বশক্তিমান দানব হল ভিন্ন ভিন্ন মানুষের এক যান্ত্রিক সংযুক্তি। ক্ষমতা হল এই কৃত্রিম দেহের প্রাণ, রাজা হলেন এই প্রাণশক্তির প্রতীক রাষ্ট্রদেহের মস্তিষ্ক, দেহের জীবন ও গতির পরিচালক। তাঁর মতে, রাষ্ট্র মানুষের অর্জিত প্রতিষ্ঠান, কারণ- ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মানুষকে এই প্রতিষ্ঠান অর্জন করতে হয়। সেইসঙ্গে এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত, কারণ- নিজেদের ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে, আনুগত্য অর্পণ করে মানুষ নিঃশর্ত ক্ষমতা প্রদান করে একে টিকিয়ে রাখে। হবস কথিত রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যাপক ও কর্তৃত্ব অবাধ, যা সকলপ্রকার আইনকানুনের ঊর্ধ্বে এবং এর কোনোরকম বণ্টন করা সম্ভব নয়। এই রাষ্ট্রকে যিনি পরিচালনা করেন, তিনিই হলেন সার্বভৌম শক্তি।
(v) সার্বভৌমিকতা: সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে হবসের তত্ত্ব রাষ্ট্রচিন্তার জগতে তাঁকে বিশিষ্টতা দান করেছে। সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে তিনিই প্রথম পরিপূর্ণ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। হবসের মতে, চুক্তির দরুন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদই হল সার্বভৌম শক্তি। সার্বভৌম ক্ষমতা একইসঙ্গে আইনের স্রষ্টা ও নৈতিকতার প্রবর্তক। তিনি বলেছেন, সার্বভৌম শাসকের দায়িত্ব হল সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সুরক্ষিত রাখা।
(vi) নাগরিক অধিকার ও চরম আনুগত্য: হবস অবাধ নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেননি। তিনি মনে করতেন সার্বভৌম শক্তির প্রতি আনুগত্য প্রকাশ বা নিজেকে রাষ্ট্রের কাছে সমর্পণ করার মধ্যেই মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা নিহিত রয়েছে। তাঁর মতে, আদিম মানুষ শান্তি ও নিরাপদ জীবনের জন্য নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে তাদের সমস্ত ক্ষমতা ও অধিকার সার্বভৌমের হাতে অর্পণ করেছে। সার্বভৌম হল চরম, অসীম ও অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী। তাই সার্বভৌমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার বা নতুন সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করার কোনও অধিকারও জনগণের হাতে থাকে না। সার্বভৌম-কর্তৃপক্ষ সৃষ্ট আইন লঙ্ঘন করলে কর্তৃপক্ষ সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে।
(vii) রাষ্ট্রব্যবস্থা: হবস তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় তিন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলেছেন- রাজতন্ত্র- যেখানে একজন ব্যক্তি বা ব্যক্তিসংসদের শাসন প্রতিষ্ঠিত এবং অভিজাততন্ত্র- যেখানে ব্যক্তিসাধারণের পরিষদ শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং গণতন্ত্র- যেখানে জনগণ সাধারণ সভার মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করে থাকে। তবে হবস রাজতন্ত্রকেই শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, রাজতন্ত্রের প্রধান গুণ হল- এটি স্থিতিশীল ও সংকটকালীন পরিস্থিতিতে বিশেষ উপযোগী।
মূল্যায়ন: টমাস হবস বর্ণিত রাষ্ট্রতত্ত্ব পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত নয়। কাল্পনিক ও পরস্পরবিরোধী, গণতন্ত্রবিরোধী মতবাদ, দায়িত্ব-কর্তব্য উপেক্ষিত, বিপজ্জনক রাষ্ট্রচিন্তা ইত্যাদি নানান দিক থেকেই তাঁর তত্ত্বের সমালোচনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর তত্ত্বের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। এক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে বড়ো অবদান হল তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র এবং জনগণের সম্মতির মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান করতে সমর্থ হয়েছিলেন। স্যাবাইন (Sabine)-এর মতে, ইংরেজ ভাষাভাষী রাষ্ট্রতত্ত্বের লেখকদের মধ্যে হবস ছিলেন সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর