জাঁ বোদার রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো
অথবা, আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে জাঁ বোদার রাষ্ট্রচিন্তার মূল বক্তব্য সম্পর্কে আলোচনা করো।
জাঁ বোদার রাষ্ট্রতত্ত্ব
জাঁ বোদা (Jean Bodin) ছিলেন ষোড়শ শতকের ফ্রান্সের একজন প্রখ্যাত দার্শনিক, আইনজ্ঞ ও পণ্ডিত। Method for the Easy Comprehension of History, Six Books of the Commonwealth প্রভৃতি গ্রন্থে জাঁ বোদার রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কিত আলোচনা স্থান পেয়েছে। তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-
(i) রাষ্ট্রের সংজ্ঞা: দার্শনিক জাঁ বোদা মনে করেন যে, ‘সংজ্ঞার মাধ্যমে যে সমস্যা বিবেচনা করা হচ্ছে তার সমাধান করা সম্ভব এবং সংজ্ঞা যদি সুনির্মিত না হয় তাহলে তার উপর ভিত্তি করে যা গড়ে তোলা হয় তা সত্বর ভেঙে পড়ে।’ তাই নিজের তত্ত্বে বোদা রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিতে উদ্যত হয়েছেন। তাঁর মতে, রাষ্ট্র হল কয়েকটি পরিবার ও তাদের যৌথ সম্পত্তির সমন্বয়ে গঠিত একটি আইনসম্মত সরকার, যা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী (The State is a lawful government, with sovereign power, of different households and their common affairs)।
(ii) পরিবারের ধারণা: পরিবারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বোদা রোমান আইন দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁর মতে, পরিবার হল পিতার নিয়ন্ত্রণাধীন কতিপয় ব্যক্তির সমষ্টি। পিতা-মাতা, পুত্র-কন্যা, গৃহভৃত্য ও তাদের যৌথ সম্পত্তির সমবায়ে তৈরি পরিবারকে বোদা স্বাভাবিক লোকসমাজ (Natural Community) বলে অভিহিত করেছেন। এই পরিবার থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
(iii) রাষ্ট্রের উৎপত্তি: রাষ্ট্রের উদ্ভব প্রসঙ্গে বোদার অভিমত হল এই যে, মানুষের সামাজিক অনুভূতি বা আবেগের পরিণতি হল পরিবার এবং অন্যান্য ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক সংগঠন। প্রাকৃতিক কারণেই একটি পরিবার থেকে একাধিক পরিবার গড়ে ওঠে। নিজেদের অস্তিত্ব ও স্বার্থরক্ষার তাগিদে পরিবারগুলি নিজেদের বসতি গড়ে তুলতে শুরু করে। এর জন্য স্থান দখল করাকে কেন্দ্র করে পরিবারগুলি একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে পরাজিতরা ক্রীতদাস হিসেবে বিজয়ী শ্রেণির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে বাধ্য হয়। আর এভাবেই বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে সমাজে বিকশিত হয় সার্বভৌম শক্তি এবং সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন সর্বোচ্চ সংগঠন হিসেবে উদ্ভব ঘটে রাষ্ট্রের।
(iv) সার্বভৌমিকতা ও আইনের ধারণা: সিসেরোর Res Republica-র ধারণা গ্রহণ করে বোদা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান ভিত্তি হিসেবে আইনের উপর গুরুত্ব দেন। বোদার মতে, একজন শাসকের হাতে আইনের দায়িত্ব থাকার পাশাপাশি যুদ্ধ করা, শান্তি স্থাপন, মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি অধিকার ন্যস্ত করা উচিত। এটি সার্বভৌমিকতা নামে পরিচিত, যা হল রাষ্ট্রের চরম ও নিরন্তর ক্ষমতা। তবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা কোনও আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। একমাত্র প্রাকৃতিক আইন সার্বভৌম ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
অপরদিকে আইন সম্পর্কে বোদার ধারণা বস্তুতপক্ষে সার্বভৌমিকতা ধারণাটিরই প্রসারিত এবং পরিবর্ধিত রূপ। তাঁর মতে, সার্বভৌমই আইনের স্রষ্টা এবং আইন হল সার্বভৌমের ইচ্ছা বা আদেশ। সার্বভৌমের প্রধান কাজ হল আইন প্রণয়ন করা।
(v) সরকারের শ্রেণিবিভাগ: বোদা রাষ্ট্র ও সরকারকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করেছেন, যথা- রাজতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক। সার্বভৌম ক্ষমতা ও অধিকার একজন ব্যক্তির হাতে থাকলে তা রাজতান্ত্রিক, এই ক্ষমতা কয়েকজনের হাতে থাকলে তা অভিজাততান্ত্রিক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতা ভোগ করলে তাকে গণতান্ত্রিক সরকার বলা যায়। বোদা উল্লেখ করেছেন যে, এই তিন সরকারের সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র বা মিশ্র রাষ্ট্র নৈরাজ্যের সৃষ্টি করতে পারে। তাই তা কখনোই কাম্য নয়। রাজতান্ত্রিক সরকার বা রাজতন্ত্রকেই তিনি সর্বোত্তম বলে বিবেচনা করেন।
(vi) রাষ্ট্রের কাজ: বোদার মতে, রাষ্ট্র সাধারণের স্বার্থ সংরক্ষণে সদাসর্বদা নিয়োজিত থাকবে। যেহেতু রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সাধারণের সম্মতির উপর নির্ভরশীল, তাই জনসাধারণ তার ন্যূনতম পরিষেবা যদি রাষ্ট্র কর্তৃক না পেয়ে থাকে তবে রাষ্ট্র বিপন্নতার শিকারে পরিণত হবে। তাই রাষ্ট্রের প্রাথমিক কাজ হল মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধান (Security), সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ এবং তার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় যতটা সম্ভব সাহায্য করা।
(vii) নাগরিকতা: রাষ্ট্রের মূল আধার বা উপাদান হল নাগরিকতা। জাঁ বোদা অবশ্য রাষ্ট্রের সকল বাসিন্দাদের নাগরিক বলতে চাননি। ক্রীতদাস, নারী, শিশুদের তিনি জনগণের অংশ বলে মনে করলেও নাগরিক বলে মনে করেননি। তিনি নাগরিক বলতে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিদের মনে করেন, যারা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তারা পরিবারের কর্তৃত্বের সীমানা ছাড়িয়ে যখন অন্যান্য পরিবারের প্রধানদের সঙ্গে মিলিত হয়ে একত্রিতভাবে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের অধীনস্থ হয়, তখন পরিবারের এই গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরাই নাগরিক হিসেবে পরিচিত হন।
(viii) বিপ্লব তত্ত্ব: বোদার রাষ্ট্রচিন্তার একটি মৌলিক চিন্তাধারা হল রাষ্ট্রের পরিবর্তন বা বিপ্লব সংক্রান্ত চিন্তাধারা। বোদার মতে, জীবদেহের মতো রাষ্ট্রের জন্ম, বৃদ্ধি ও ধ্বংস হয়। আর এই পথ ধরেই রাষ্ট্রের উন্নতি ও প্রগতির ধারা অব্যাহত থাকে। রাষ্ট্রের মৃত্যু অর্থাৎ অবক্ষয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রের পরিবর্তন ঘটে এবং এক কর্তৃপক্ষের হাত থেকে অন্য কর্তৃপক্ষের হাতে স্থানান্তরিত হয় সার্বভৌম ক্ষমতা। সুতরাং, রাষ্ট্রের পরিবর্তন বা রাষ্ট্রবিপ্লব একটি স্বাভাবিক ঘটনা। বোদা মনে করেন, রাষ্ট্রবিপ্লব দুধরনের হতে পারে- Alteratio অর্থাৎ রাষ্ট্রবিপ্লবের ফলে আইন ও অন্য প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন ঘটলেও সার্বভৌমিকতা অপরিবর্তিত থাকে এবং Conversio অর্থাৎ এক্ষেত্রে বিপ্লবের কঠোর প্রয়োগের ফলে সার্বভৌমিকতার পরিবর্তন ঘটে। বোদার মতানুসারে, তিনটি কারণে বিপ্লব হতে পারে- ঐশ্বরিক, প্রাকৃতিক ও মানবিক। এর মধ্যে ঐশ্বরিক কারণগুলি হল অদৃশ্য ও অজ্ঞাত। অন্যদিকে প্রাকৃতিক কারণগুলি চন্দ্র, সূর্য, গ্রহনক্ষত্রের প্রভাবাধীন, যা জ্যোতিষবিদ্যার সহায়তায় মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম। আর বিপ্লবের মানবিক কারণগুলি বিশ্লেষণ করে বোদা শাসককে অসাম্য প্রশমিত করা, নাগরিকদের অনিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের সুযোগ না দেওয়া প্রভৃতি পরামর্শ দিয়েছেন।
মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায় যে, বোদার রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়। মধ্যযুগীয় মানসিকতা, স্ববিরোধী বক্তব্য, সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে অস্পষ্টতা, ব্যক্তির ভূমিকাকে স্বীকার না করা প্রভৃতির দরুন বোদার তত্ত্ব সমালোচিত হয়েছে যথেষ্ট। তবে ত্রুটি থাকলেও সার্বভৌমত্বের আদর্শ, ধর্মনিরপেক্ষতা, আধুনিক ভাবধারা ইত্যাদির জন্য বোদার রাষ্ট্রতত্ত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই ডানিং (Dunning), গেটেল (Gettell) প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে বোদার অবদানকে অমূল্য সম্পদ বলে মনে করেন।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর