গণতন্ত্রের উদ্ভবের কারণগুলি ব্যাখ্যা করো
গণতন্ত্রের উদ্ভবের কারণসমূহ
গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে ঐতিহাসিক, দার্শনিক, সামাজিক কারণগুলির সংমিশ্রণ থেকে উদ্ভূত হয়, যা এর উত্থান এবং স্থায়িত্বে অবদান রাখে। এখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও রক্ষাণাবেক্ষণে অবদানকারী কিছু মূল কারণ রয়েছে। এগুলি হল-
(i) আলোকদ্বীপ্ত ধারণার উদ্ভব: ১৭ এবং ১৮ শতকে আলোকদীপ্তির সময়কালে জন লক্, জ্যাঁ জ্যাক্ রুশো এবং মন্তেস্কু-এর মতো দার্শনিকরাও প্রাকৃতিক অধিকার, সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব এবং ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিগুলির সম্পর্কে বলেছিলেন। এই ধারণাগুলি শাসিতের সম্মতি, আইনের সমতা এবং ব্যক্তির অধিকারের সুরক্ষার উপর জোর দিয়ে, গণতান্ত্রিক শাসনে জ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
(ii) গণতান্ত্রিক বিপ্লব: আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম (১৭৭৬ খ্রি.)-এর সময় আমেরিকার উপনিবেশগুলি ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য লড়াই করেছিল, যার ফলে পরবর্তীকালে আমেরিকায় প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার সুরক্ষার মতো গণতান্ত্রিক নীতিগুলির উপর ভিত্তি করে একটি সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঐক্যবদ্ধ – রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পরবর্তীকালে ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রি.) জনপ্রিয় সার্বভৌমত্ব, সাম্য, স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে রাজতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, যা ভবিষ্যতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথকে ত্বরান্বিত করেছিল।
(iii) শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাব: শ্রমিক আন্দোলন এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলি রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব, শ্রমিকদের অধিকার এবং সামাজিক সংস্কারের জন্য দাবি জানাতে থাকে। তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল ভোটাধিকার সম্প্রসারণের মাধ্যমে সকলের রাজনৈতিক অধিকারকে সুনিশ্চিত করা এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে বৃদ্ধি করা। শ্রমিক সংগঠনগুলির এই দাবি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছিল।
(iv) নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রভাব: স্বাধীন গণমাধ্যম, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (NGO) এবং তৃণমূল স্তরের আন্দোলন-সহ শক্তিশালী পৌর সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি গণতান্ত্রিক সংস্কার দ্বারা নাগরিকদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করে এবং সরকারকে দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য করে। চরম সাম্যবাদ, নারীর অধিকার, আদিবাসী অধিকার এবং এল জি বি টি (LGBT) অধিকার আন্দোলনে প্রান্তিক গোষ্ঠিকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গণতান্ত্রিক নীতিগুলি প্রসারিত হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সমতাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
(v) অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন: নিয়মিত নির্বাচন নাগরিকদের তাদের প্রতিনিধি চয়ন করতে, রাজনৈতিক পছন্দ প্রকাশ করতে সাহায্য করে এবং নির্বাচিত কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য করে, যা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য উপাদান হিসেবে গণ্য হয়।
(vi) মধ্যবিত্তাশ্রণির সম্প্রসারণ: অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং মধ্যবিত্তের উত্থান ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব, সম্পত্তির অধিকারের সুরক্ষা এবং দায়বদ্ধতামূলক শাসনের সাথে জড়িত, যা গণতন্ত্রের উত্থানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
(vii) শিক্ষা ও স্বাক্ষরতা: উচ্চস্তরের শিক্ষা ও স্বাক্ষরতা নাগরিকদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে, সিদ্ধান্ত নিতে এবং রাজনৈতিক সমালোচনা করতে সাহায্য করে।
(viii) আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রভাব: মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক শাসন তথা আইনের শাসনের প্রচারকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা, চুক্তি এবং তাদের নিয়মগুলি গণতান্ত্রিক সংস্কারসমূহ এবং গণতান্ত্রিক নীতিসমূহকে সমুন্নত রাখার জন্য দেশগুলির উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে।
(ix) কুটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক : বাণিজ্য, কূটনীতি ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলির যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তার ভিত্তিতেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বৈধতা অর্জনের জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কার গ্রহণ করতে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা উৎসাহিত হয়।
(x) দায়িত্বশীল নেতৃত্ব: রাজনৈতিক নেতারা, যারা তাদের নাগরিকদের চাহিদা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি প্রতিক্রিয়াশীল, নিজেদের সম্পাদিত কর্মের জন্য দায়বদ্ধ, গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তারা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠন করতে ও তা টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
(xi) কর্তৃত্ববাদী উত্তরণ: স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্ত দেশগুলি শান্তিপূর্ণ সংস্কারের মাধ্যমে অথবা জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রায়শই গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে, রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে উন্নত করতে এবং মানুষের প্রতি সম্মান নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হয়।
আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর