ক্রুসেডের সূত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের (প্রতীচ্য) মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের গুরুত্ব কী ছিল
ক্রুসেডের মূল উদ্দেশ্য জেরুজালেমকে সেলজুক তুর্কিদের হাত থেকে মুক্ত করা হলেও, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদানেও তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। ধর্মযুদ্ধের ফলে ব্যাবসাবাণিজ্যের সম্প্রসারণ হয়, তার সঙ্গে ইউরোপীয়দের মধ্যে বৃদ্ধি পায় ভৌগোলিক জ্ঞান। বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির প্রসার ঘটে। প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের এই সম্পর্ক স্থাপন ইউরোপীয় সমাজের আধুনিকীকরণে সাহায্য করেছিল।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের গুরুত্ব
(1) প্রাচ্যে বাণিজ্যের সম্প্রসারণ: ক্রুসেডের হাত ধরে প্রাচ্যের দেশগুলিতে ইউরোপীয় বাণিজ্যের পুনরুজ্জীবন ঘটে। ক্রুসেডের ফলে খ্রিস্টান জনগণের সঙ্গে প্রাচ্যের প্রত্যক্ষ সংযোগ বাণিজ্যে নতুন গতি নিয়ে আসে। ইটালির নগররাষ্ট্র ভেনিস ক্রুসেডার এবং তাদের খাদ্যসম্ভার প্রাচ্যের দেশগুলিতে পৌঁছে দেওয়ার পর সেখানকার বিপুল পণ্য ইউরোপে আমদানি করতে থাকে। এই দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয় অন্যান্য নগররাষ্ট্রের বণিককুল। তৈরি হয় বৃহদাকার জাহাজ। বাণিজ্যসূত্রে স্থাপিত হয় বহু নতুন নগর ও শহর। প্রাচ্যের দেশগুলিতে ইউরোপীয় শিল্পপণ্যের বাজার যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনই ইউরোপের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় প্রাচ্যের রেশম বস্ত্র, কার্পাস বস্ত্র, সুগন্ধি, খেজুর ইত্যাদি লোভনীয় পণ্যসম্ভার।
(2) ভৌগোলিক জ্ঞান বৃদ্ধি: দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে বহু ধর্মযোদ্ধা কখনো স্থলপথে, কখনো জলপথে জেরুজালেম পৌঁছেছিল। ফলে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলি, এশিয়া ও আফ্রিকা সম্বন্ধে তাদের স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়। পরবর্তীকালে এই ভৌগোলিক জ্ঞান সমুদ্রযাত্রা ও ভৌগোলিক আবিষ্কারের পথ নির্দেশ করে।
(3) সাংস্কৃতিক বিকাশ: ক্রুসেডের ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে জ্ঞানের আদানপ্রদানের সূত্রে এশিয়ার কাগজ, কম্পাস, আতস কাচ প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ইউরোপে পৌঁছোয়। ফলে সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্রুত বিস্তার ঘটে। তার সঙ্গে আরবি ভাষার রচনাসমূহ ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হতে শুরু করে। ইবন সিনা, ইবন রশিদ ও অন্যান্য আরব পণ্ডিতগণ ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অধ্যাপনা শুরু করেন। এই পর্বে আরব্য রজনী, পঞ্চতন্ত্রের মতো বিখ্যাত প্রাচ্যদেশীয় সাহিত্যকর্ম ইউরোপীয় সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিল।
(4) ইউরোপীয় জীবনধারায় প্রাচ্যের প্রভাব: ক্রুসেডে যোগদানের ফলে ধর্মযোদ্ধাদের দীর্ঘদিন নিজের দেশ ছেড়ে প্রাচ্যে থাকতে হত। ফলে ইউরোপীয় ধর্মযোদ্ধাদের পোশাকে, খাদ্যপ্রণালীতে প্রাচ্যের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মূল্যায়ন
পরিশেষে বলা যায়, ক্রুসেডের ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। প্রাচ্যে বাণিজ্যের পথ সুগম হলে ইউরোপীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় গতি আসে এবং ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প বিকাশ লাভ করে। প্রাচ্যের সমরবিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল ইউরোপীয়রা। ধর্মযুদ্ধের সূত্রে প্রাচ্যের উন্নত সভ্যতা-সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে মধ্যযুগীয় আচার-আচরণে অভ্যস্ত ইউরোপীয়দের মধ্যে মননশীলতার চর্চা শুরু হয়। খ্রিস্টান জগৎ আঞ্চলিক সংকীর্ণতা মুক্ত হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর