ক্রুসেডের অর্থনৈতিক কারণ আলোচনা করো
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তথা কারণ বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক পি কে হিট্টি (PK Hitti) বলেছেন যে- ‘চার্চের ক্রুশ, সৈনিকের তলোয়ার এবং বণিকদের অর্থ মিলিত হয়ে ক্রুসেডের সূত্রপাত করেছিল।’ অর্থাৎ, পশ্চিম ইউরোপে শুরু হওয়া ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছরব্যাপী সংঘটিত ধর্মযুদ্ধের পশ্চাৎপটে কেবল ধর্মীয় নয়, নানান অর্থনৈতিক কারণও দায়ী ছিল।
ক্রুসেডের অর্থনৈতিক কারণসমূহ
(1) বণিকদের স্বার্থচিন্তা: ইটালির নগররাষ্ট্রগুলি অন্তর্দেশীয় ও বহির্বাণিজ্যে খুব অগ্রণী ছিল। কিন্তু খ্রিস্টীয় নবম শতকে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের দুর্বলতা এবং ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের ফলে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল মুসলিম হ্রদে পরিণত হয়। ফলে পূর্ব ও পশ্চিম রোমের যোগাযোগ যেমন ব্যাহত হয়, তেমনই ইটালির বাণিজ্যমুখী নগররাষ্ট্রগুলির সমুদ্রবাণিজ্যেও মন্দা দেখা দেয়। একাদশ শতকে নর্সম্যান (ন্যান) উপজাতির হাতে মুসলমানদের পরাজয় ঘটলে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরে ইতালীয় বণিকদের ব্যাবসা পুনরায় শুরু হয়। সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত অঞ্চলে জেনোয়া, পিসা, ভেনিস প্রভৃতি ইতালীয় নগররাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। এখন ভূমধ্যসাগরকে মুসলিম কর্তৃত্বমুক্ত করতে পারলে ইটালির বাণিজ্য ইউরোপ থেকে প্রাচ্যের দেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়বে, এমন সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। ঠিক এই সময়ে পোপ ধর্মযুদ্ধের ডাক দিলে জেনোয়া-সহ ইটালির নগররাষ্ট্রগুলি আশার আলো দেখতে পায়। ধর্মীয় আন্দোলনের এই সুযোগে তারা বাণিজ্যবৃদ্ধির পরিকল্পনা করে এবং ধর্মযুদ্ধে যোগ দেয়। এইভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা ও বাণিজ্যিক স্বার্থ একীভূত হয়ে ক্রুসেড অনিবার্য করে তোলে।
(2) জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত চাপ: দশম শতকের শেষদিক থেকে ইউরোপের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। বর্ধিত জনসংখ্যার অনুপাতে চাষযোগ্য জমি বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ফলে বহু মানুষ ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়। বিকল্প আয়েরও তেমন সুযোগ ছিল না। জীবন ও জীবিকার এই অনিশ্চয়তা অনেক মানুষের মনে তীব্র অস্থিরতা ও অসন্তোষ সঞ্চারিত করে। ধর্মযুদ্ধের আহ্বান এবং মহান লক্ষ্যে দেশের বাইরে গিয়ে ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন তাদের মনে নতুন প্রেরণা জোগায়। এই শ্রেণির অসংখ্য মানুষ পোপের আহ্বানে ক্রুসেডে যোগ দেয়।
(3) আর্থিক উন্নতির স্বপ্ন: ইউরোপের ধনী অভিজাতরা ক্রুসেডের মাধ্যমে আরও ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এ ছাড়া যুদ্ধের সময় লুঠতরাজের মাধ্যমে ম্যানর প্রভুরা তাদের আয়বৃদ্ধির সম্ভাবনার বিষয়েও আশান্বিত হন। এর ফলে পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়।
আরও পড়ুন –
১। সামন্ততন্ত্র বলতে কী বোঝায়?
২। ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল?
৩। ‘ফিফ’ ও ‘শিভালরি বলতে কী বোঝো?
৪। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণ সম্পর্কে লেখো।
৫। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের ইতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?
৬। ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের নেতিবাচক প্রভাবগুলি কী ছিল?
৭। পোপতন্ত্রের বিকাশের কারণগুলি লেখো।
৮। ইউরোপে মধ্যযুগকে ‘অন্ধকার যুগ (Dark Age) বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত?
১০। সেন্ট বেনেডিক্ট-এর সংস্কারসমূহ সম্পর্কে লেখো।
১২। টীকা লেখো- ক্লুনির সংস্কার আন্দোলন।
১৩। ওয়ার্মস-এর চুক্তির তাৎপর্য লেখো।
১৪। ক্রুসেড’ কী?