উত্তরের মানবতাবাদ বা রেনেসাঁ কী
অথবা, ইউরোপীয় নবজাগরণ কি শুধু ইটালিকেন্দ্রিক ছিল?
অথবা, ইটালির বাইরে সাহিত্যে মানবতাবাদী ভাবধারার পরিচয় দাও
উত্তরের মানবতাবাদ বা রেনেসাঁ / নবজাগরণ কি শুধু ইটালিকেন্দ্রিক ছিল-ব্যাখ্যা
(1) ধারণা: মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের রূপান্তরের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল নবজাগরণ। ইউরোপে পঞ্চদশ শতকের নবজাগরণের মূলকেন্দ্র ছিল ইটালি বা আরও স্পষ্টভাবে বললে উত্তর ইটালির নগররাষ্ট্রগুলি। তবে ইটালির রেনেসাঁ শুধু ইটালিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাণিজ্য করতে আসা বণিক, শিল্পশৈলীর গুণগ্রাহী শিল্পীগণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে আগত ছাত্রদের মাধ্যমে ইটালির উৎসভূমি থেকে মানবতাবাদের ধারা আল্পস পর্বতমালার উত্তরে অবস্থিত জার্মানি, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এখানকার রাজন্যবর্গ এবং বণিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় নবজাগরণ ও মানবতাবাদের শিক্ষা আরও প্রসারিত হয়। এই বৌদ্ধিক আন্দোলন উত্তরের নবজাগরণ (Northern Renaissance) বা উত্তরের মানবতাবাদ নামে পরিচিত।
(2) বিস্তার:
- জার্মানি: আল্পসের উত্তরে জার্মানিতে ইতালীয় রেনেসাঁ এবং রেনেসাঁ-প্রসূত মানবতাবাদের প্রভাব প্রথম পরিলক্ষিত হয়। এখানকার বাসেল, নুরেমবার্গ-এর মতো নগরে নাগরিক স্বাধীনতা ছিল ইটালির সমতুল্য। বাণিজ্য এবং সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম কেন্দ্র জার্মানির রাজন্যবর্গ এবং নগরের বণিকরা এসময়ে উন্মুক্ত হৃদয়ে মানবতাবাদী পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে এগিয়ে আসেন। তবে জার্মান পণ্ডিতগণ মনে করতেন যে, বাইবেলের শুদ্ধপাঠ এবং তাকে সঠিক অনুসরণের দ্বারা ধর্মীয় নবজাগরণ সম্ভব হবে। জার্মান মানবতাবাদী পণ্ডিতদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন জোহান রিউক্লিন, সেবাস্টিয়ান ব্রান্ট, আলব্রেখট ডুরার প্রমুখ। রিউক্লিন এবং ব্রান্ট তাঁদের লেখনী এবং ডুরার তাঁর মুদ্রণ বিষয়ক কর্মকান্ডের মাধ্যমে জার্মান নবজাগরণে গতির সঞ্চার করেন। আর মার্টিন লুথার ছিলেন এই ধারার সার্থক উত্তরাধিকারী। তিনি জার্মান ভাষায় বাইবেল অনুবাদ ও ছাপার ব্যবস্থা করে জার্মান গদ্যসাহিত্যের উন্নতির পথ খুলে দেন।
- নেদারল্যান্ড: নেদারল্যান্ডের উপরেও রেনেসাঁর প্রভাব বিশেষভাবে অনুভূত হয়েছিল। অবশ্য এই পর্বে ওলন্দাজ সংস্কৃতির উপর দক্ষিণ জার্মানির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আল্পসের উত্তরে মানবতাবাদী আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন ওলন্দাজ পণ্ডিত ডেসিডেরিয়াস ইরাসমাস। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করে তিনি মানবতাবাদী ধারণা প্রচার করেন। বস্তুত ইরাসমাস ও তাঁর অনুগামীদের লক্ষ্য ছিল খ্রিস্টান নবজাগরণ (Christian Renaissance)। মানবতাবাদীদের রাজপুত্র অভিধায় ভূষিত ইরাসমাসের বিখ্যাত রচনাটি হল ইন প্রেইজ অফ ফলি (In Praise of Folly), যেখানে তিনি মূলত ব্যঙ্গাত্মক রূপে চার্চের ত্রুটি ও যাজকদের ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা তুলে ধরেন।
- ফ্রান্স: ফ্রান্সেও মানবতাবাদীগণ খ্রিস্টীয় মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটান। তাছাড়া এসময় প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা হয়। তবে প্রাক্-নবজাগরণ পর্বে ফ্রান্সে টুবাদুর (Troubadour) নামক একদল ভ্রাম্যমাণ চারণকবি তাঁদের গীতিকবিতাগুলির মাধ্যমে চার্চ ও যাজকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তাই চার্চ এঁদের ধর্মচ্যুত ঘোষণা করে। নবজাগরণ পর্বের ফ্রান্সের জনপ্রিয় লেখক ও চিকিৎসক ছিলেন ফ্রাঁসোয়া রাবেলে। তাঁর বিখ্যাত দুটি রচনা হল গারগাটুয়া ও প্যান্টাগুয়েল। অপরদিকে এই পর্বের একজন বিশিষ্ট দার্শনিক ছিলেন মিশেল দ্য মতেইন- স্বাধীন ও বলিষ্ঠ লেখনীর জন্য যিনি বিখ্যাত ছিলেন।
- স্পেল: স্পেনে মানবতাবাদের অবস্থান কিছুটা স্বতন্ত্র ছিল। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে স্পেন ছিল চার্চের নিয়ন্ত্রণে। তাই স্পেনে মানবতাবাদের প্রাথমিক প্রয়াস দেখা যায় চার্চের কর্মকান্ডের মধ্যেই। কার্ডিনাল ফ্রান্সিসকো জিমেনেস নিজ উদ্যোগে আলকালা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে যাজকদের গ্রিক এবং প্রাচ্যভাষায় সদ্ধর্মের শিক্ষা দেওয়া হত। খ্রিস্ট ধর্মের মানবপ্রেমের বাণী ও তার গভীরতা সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করা হত। মিগুয়েল দ্য সারভেনটিস ছিলেন এই পর্বের একজন প্রখ্যাত যোদ্ধা, কবি, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক। তাঁর ডন কুইকজোট নামক উপন্যাসটি সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ।
- ইংল্যান্ড: ইংল্যান্ডে খ্রিস্টীয় মানবতাবাদের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ বহু মানুষ ব্যক্তিগত প্রতিভার জোরে পরম্পরাগত ধ্যানধারণার বিরোধিতা করেন। এর মূলে ছিল ইটালি ও ইংল্যান্ডের মনীষীদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও ভাববিনিময়। ফ্লোরেন্সের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তাঁরা অক্সফোর্ড (Oxford)-এর মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মানবতাবাদের চেতনা সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দেন। আলোচ্য পর্বে জিওফ্রে চসার, টমাস মোর, ফ্রান্সিস বেকন, উইলিয়ম শেকস্পিয়র প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ইংল্যান্ডে মানবতাবাদী ভাবধারার প্রসারে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন।
মূল্যায়ন
বস্তুতপক্ষে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নবজাগরণের ধারা ইউরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ও বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নরূপে তা বিকাশলাভ করে। প্রতিটি অঞ্চলে স্থানীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে নবজাগরণের যে মেলবন্ধন ঘটে, তা ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের প্রসারে সহায়ক হয়। তাই বলা যায় যে, নবজাগরণ শুধুমাত্র ইটালিকেন্দ্রিক ছিল না।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর