ইতালীয় সাহিত্যে মানবতাবাদী ভাবধারার পরিচয় দাও

ইতালীয় সাহিত্যে মানবতাবাদী ভাবধারার পরিচয় দাও

অথবা,

ইতালীয় রেনেসাঁ সাহিত্যের ক্ষেত্রে কীরূপ অগ্রগতি ঘটিয়েছিল

নবজাগরণের মুক্ত হাওয়া জীবনের যে দিকগুলিকে সর্বাধিক আন্দোলিত করেছিল, তাদের অন্যতম হল সাহিত্য, শিল্প ও বিজ্ঞান। বস্তুত পঞ্চদশ শতকের পরবর্তীকালে আধুনিক সাহিত্য ও শিল্পরসের উদ্ভব ঘটেছে। তবে তার ক্ষেত্র-প্রস্তুতি চলেছে আরও অনেক আগে থেকে, যার উৎসভূমি ছিল ইটালি।

ইতালীয় সাহিত্যে মানবতাবাদী ভাবধারার পরিচয়

(1) দান্তে আলিগিয়েরি (১২৬৫-১৯২১ খ্রিঃ): মধ্যযুগীয় ইটালির একজন বিশিষ্ট কবি ছিলেন দান্তে আলিগিয়েরি (Dante Alighieri) I তাঁর সাহিত্য রচনার ভাষা ল্যাটিন হলেও, মাতৃভাষা টাসকান (Tuscan)-কেও তিনি কিন্তু দূরে সরিয়ে দেননি। আধুনিক ইতালীয় ভাষার উৎপত্তি এই টাসকান থেকেই। দান্তের অমর সৃষ্টিগুলির মধ্যে অন্যতম হল ডিভাইন কমেডি (Divine Comedy), যাকে ইতালীয় ভাষার শ্রেষ্ঠ কাব্য বলে অভিহিত করা হয়। এ ছাড়াও ডিভাইন কমেডির অন্যান্য অংশ হিসেবে তিনি রচনা করেন- ইনফারনো (Inferno), পারগেটরি (Purgatory) এবং প্যারাডাইস (Paradise)। দান্তেকে ইতালীয় ভাষায় জনক নামে অভিনন্দিত করা হয়।

(2) ফান্সিস পেত্রার্ক (১৯০৪-১৩৭৪ খ্রিঃ): ফ্রান্সিস পেত্রার্ক (Francis Petrarch) হলেন ইতালীয় রেনেসাঁর প্রথম মানবতাবাদী (The first humanist in the Renaissance)। পেত্রার্ক হোমার (Homer)-এর ইলিয়াড (Iliad) এবং ওডিসি (Odyssey)-র ল্যাটিন অনুবাদ করেন। প্রেমিকা লরা (Laura)-র উদ্দেশে লেখা তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের নাম সনেটস্ টু লরা (Sonnets to Laura)। পেত্রার্ক খ্যাতিলাভ করেন তাঁর পত্রাবলির জন্য-এগুলির মধ্যে রোমের বিখ্যাত বাগ্মী সিসেরোর পত্রাবলি বিখ্যাত। তাঁর চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্যই ছিল আধুনিকতার বিকাশের জন্য অতীতের গভীর চেতনা। জীবনমুখী সাহিত্যে পেত্রার্কের অবদানের কথা স্মরণ করে ঐতিহাসিক উইল ডুরান্ট তাঁকে নবজাগরণের জনক (Father of Renaissance) বলে অভিহিত করেছেন

(3) জিওভানি বোকাচ্চিও (১৩১৩-১৩৭৫ খ্রিঃ): ইটালির অপর এক মানবতাবাদী পণ্ডিত ছিলেন জিওভানি বোকাচ্চিও (Giovanni Boccaccio) | পেত্রার্কের সমসাময়িক বোকাচ্চিও কবিতা লেখার পাশাপাশি গদ্যসাহিত্যের ক্ষেত্রেও নতুনত্ব আনেন। ১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিধ্বংসী প্লেগের পটভূমিতে লেখা তাঁর প্রসিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ডেকামেরন (Decameron) ইতালীয় গদ্যসাহিত্যের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এই গ্রন্থে বোকাচ্চিও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে মধ্যযুগীয় নানা আচার-অনুষ্ঠান ও সংস্কারগুলিকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। তাঁর সাহিত্যে মানবিক শক্তির জয়গান ধ্বনিত হয়। তিনি ইতালীয় গদ্যসাহিত্যের জনক নামেও পরিচিত।

(4)  লরেঞ্জো ভাল্লা (১৪০৭-১৪৫৭ খ্রিঃ): পঞ্চদশ শতকের মানবতাবাদী আন্দোলন সম্ভবত শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছিল লরেঞ্জো ভাল্লা (Lorenzo Valla)-র জীবন ও কীর্তির মধ্যে। অন প্লেজার (On Pleasure) নামক প্রবন্ধটি হল তাঁর বিখ্যাত রচনা।

(5) নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭ খ্রিঃ): নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (Niccolo Machiavelli) ছিলেন একজন প্রখ্যাত দার্শনিক, রাজনৈতিক  চিন্তাবিদ, কূটনীতিবিদ, নাট্যকার, কবি ও ঐতিহাসিক। রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক ম্যাকিয়াভেলির দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল-দ্য প্রিন্স (The Prince, ১৫১৩ খ্রি.) এবং দ্য ডিসকোর্সেস (The Discourses F, ১৫১৭ খ্রি.)। তিনি আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নিউটন ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত হন।

(6) অন্যান্য ইতালীয় সাহিত্যিকগণ: ইটালির অন্যান্য বিখ্যাত সাহিত্যিকগণ হলেন কলুচ্চিও সালুতাতি (Coluccio Salutati), পজিও ব্রাসিওলিনি (Poggio Bracciolini), ম্যাটিয়ো পালমিরি (Matteo Palmieri), মার্সিলিয়ো ফিচিনো (Marsilio Ficino), পিকো ডেল্লা মিরানদোলা (Pico della Mirandola) প্রমুখ। ম্যাটিয়ো পালমিরি রচনা করেন অন সিভিক লাইফ (On Civic Life) নামক একটি বিখ্যাত প্রবন্ধ, যেখানে তিনি শৌর্য ও বীরত্বের প্রশংসা করেছেন। পজিও ব্রাসিওলিনির রচনা হল অন অ্যাভেরাইস (On Avarice) নামক প্রবন্ধটি। পিকো ডেল্লা মিরানদোলা তাঁর নবজাগরণের ইস্তেহার (Manifesto of the Renaissance) নামক থিসিসের ভূমিকা হিসেবে রচনা করেন বিখ্যাত ওরেশন অন দ্য ডিগনিটি অফ ম্যান (Oration on the Dignity of Man)। এখানে তিনি বলেন যে, মানুষ নিজেই তার জীবনকে গড়ে তুলতে সক্ষম এবং ঈশ্বরই তাকে সে অধিকার অর্পণ করেছেন। মিরানদোলার মতে, আত্মশক্তি সচেতন মানুষের পক্ষে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কারণ- মানুষ স্বয়ং ম্যাগাস (Magus) বা জাদুকরি শক্তির অধিকারী।

মূল্যায়ন

মধ্যযুগে ল্যাটিন ভাষা সাহিত্যের মাধ্যম হলেও, মানবতাবাদী সাহিত্যচর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষা। ক্রমশ ল্যাটিন ভাষার পরিবর্তে স্থানীয় ও কথ্য ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু হয়। ইটালির উর্বর ভূমিতে সাহিত্য যে নবজীবন লাভ করে, তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে। সব দেশের নিজস্ব মাতৃভাষা তৈরি হয়, মুদ্রণযন্ত্রের দ্রুত বিস্তার সাহিত্য সৃষ্টিতে অনুঘটকের কাজ করে। জন্ম হয় আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্যের।

আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment