ইটালির নবজাগরণে ফ্লোরেন্স নগরের ভূমিকা কী ছিল

ইটালির নবজাগরণে ফ্লোরেন্স নগরের ভূমিকা কী ছিল

ইউরোপে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল নবজাগরণ বা রেনেসাঁ। ইটালিতে এই নবজাগরণ প্রথম দেখা যায়। অনেকেই আবার ফ্লোরেন্স নগরকে ইতালীয় নবজাগরণের উৎসকেন্দ্র বা স্বগৃহ বলে মনে করেন।

ইটালির নবজাগরণে ফ্লোরেন্স নগরের ভূমিকা

বস্তুত নানান কারণে ফ্লোরেন্স নবজাগরণ সংস্কৃতির ধাত্রীতে পরিণত হয়েছিল-

(1) উন্নত বাণিজ্য: ক্রুসেডের সময় থেকে প্রাচ্যের সঙ্গে ফ্লোরেন্স ও ভেনিসের প্রায় একচেটিয়া ব্যাবসাবাণিজ্য চলত। প্রাচ্যের বিলাসদ্রব্য আমদানি করে ফ্লোরেন্স বিপুল মুনাফা সংগ্রহ করে এবং অতিরিক্ত সম্পদ সৃজনশীল কাজে ব্যয় করার প্রবণতা তৈরি হয়।

(2) উন্নত ব্যাংকিং ব্যবস্থা: ক্রুসেডের পর ফ্লোরেন্স বৃহৎ ব্যাংকিং কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। ত্রয়োদশ শতক থেকে ফ্লোরেন্সবাসী রাজা ও পোপের সরকারি ব্যাংকার (Banker)-এ পরিণত হয়। ১৪২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মেডিচি পরিবার (House of Medici) পোপের ব্যাংকার হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। আসলে, খ্রিস্টধর্মে সুদগ্রহণ ধর্মবিরোধী কাজ হিসেবে বিবেচিত হত। তাই এই অনুশোচনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই মেডিচি পরিবারের মতো ফ্লোরেন্সের ব্যাংকিং পরিবারগুলি তাদের লাভের একটা বড়ো অংশ শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় ব্যয় করত।

(3) মেডিচি পরিবারের ভূমিকা: ফ্লোরেন্সের শাসনক্ষেত্রে মেডিচিদের একক ক্ষমতালাভ, প্রজাতান্ত্রিকতার পরিবর্তে প্রায় রাজতান্ত্রিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেও তাঁদের সংস্কৃতিমনস্কতা নবজাগরণের উৎসকেন্দ্ররূপে ফ্লোরেন্সের উত্থানের পথে কখনোই বাধা সৃষ্টি করেনি। বরং মেডিচিদের অর্থানুকূল্যেই ফ্লোরেন্স শিল্প-সংস্কৃতি-মননশীলচর্চার প্রধান কেন্দ্রে উন্নীত হতে পারে।

(4) সৃজনশীল প্রতিভার অস্তিত্ব: রেনেসাঁর মহত্ত্বের প্রসঙ্গে যাঁদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়, সেই জিওত্তো (Giotto), ম্যাসাচিও (Masaccio), বুনেলেস্কি (Brunelleschi), দোনাতেল্লো (Donatello) প্রমুখের প্রেরণা ও ধাত্রীস্বরূপা ছিল ফ্লোরেন্স। ফ্লোরেন্স নগরীর সম্পদ, উদারতা এবং সামাজিক পরিবেশ বিশ্বখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (Leonardo da Vinci) মাইকেল এঞ্জেলোর মতো প্রতিভাদের বিকাশের ক্ষেত্র গড়ে দিয়েছিল। আরও বহু নামী-অনামী শিল্পী, সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ ফ্লোরেন্স নগরীর পৃষ্ঠপোষকতায় নবজাগরণ আন্দোলনকে একটা ঊর্ধ্বতর পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

(5) ঐতিহ্যের পুনরূদ্ধার: ফ্লোরেন্সের মুক্ত জীবন, বৈঠকখানা, পানশালা, লেখকের গৃহ, উপাসনালয় ইত্যাদি স্থানে নানা বিষয় নিয়ে অবাধ আলোচনা, তর্কবিতর্ক ফ্লোরেন্সবাসীকে ঐতিহ্যের মহত্তর দিকগুলি উদ্ধারের কাজে অনুপ্রাণিত করত। অ্যারিস্টটল, প্লেটো, টলেমি, সক্রেটিস প্রমুখ প্রাচীন লেখকদের রচনার পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে ফ্লোরেন্সীয় জনগণ এক নতুন সমাজের সন্ধান পেয়েছিল, যা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র, ও উন্নত।

(6) রাজনৈতিক অবস্থা : ফ্লোরেন্সের সমকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। জার্মান আধিপত্যের বিরুদ্ধে ফ্লোরেন্সের দীর্ঘ লড়াই এবং মিলানের বিরুদ্ধে ফ্লোরেন্সবাসীর প্রজাতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা নবজাগরণের পথ মসৃণ করে। প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি ফ্লোরেন্সবাসীর আস্থা জন্ম দেয় নাগরিক মানবতাবাদের।

মূল্যায়ন

উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইটালির নবজাগরণের ক্ষেত্রে ফ্লোরেন্সের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফ্লোরেন্সের ব্যাবসাবাণিজ্য থেকে শুরু করে মেডিচি পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা, এমনকি ফ্লোরেন্সবাসীদের মুক্ত মানসিকতা-এই সবই নবজাগরণের জন্ম দেয়। আর এই নবজাগরণ ক্রমশ ফ্লোরেন্স থেকে ইউরোপের সর্বত্র বিস্তারলাভ করে।

আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment