ইউরোপে রেনেসাঁর প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো

ইউরোপে রেনেসাঁর প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো

ইউরোপে রেনেসাঁর প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো
ইউরোপে রেনেসাঁর প্রভাব সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো

পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতক নাগাদ ইউরোপে সংগঠিত হওয়া সামাজিক, সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণই ছিল রেনেসাঁ বা নবজাগরণের প্রধান উদ্দেশ্য। ইউরোপীয় সমাজে এই নবজাগরণের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ।

ইউরোপে রেনেসাঁর প্রভাব

(1) মানসিকতার পরিবর্তন: রেনেসাঁর দরুন মানুষের নৈতিক ও মানসিক ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটেছিল। এসময় চিরাচরিত খ্রিস্টীয় অনুশাসনের প্রতি মানুষের মনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। এইরূপ মননশীল আন্দোলনের ফলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী চেতনার উদ্ভব ঘটে। মানুষের নৈতিকতা, যুক্তি, জ্ঞানের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। শুরু হয় মানবতাবাদের চর্চা।

(2)  শিল্প-স্থাপত্যে পরিবর্তন: আলোচ্য পর্বে শিল্পীরা ধ্রুপদি ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধার করে তার সঙ্গে দক্ষতা ও কল্পনার সমন্বয় ঘটান। তারা প্রেক্ষিত (Perspective) ব্যবহার করে শিল্পকর্মকে বহুমাত্রিক রূপ দেন। ধর্মীয় ভাবনার পাশাপাশি তাদের শিল্পে ধর্মনিরপেক্ষ বা জীবনমুখী ঘটনাবলিও ফুটে উঠতে থাকে। এইভাবেই পূর্বের তুলনায় শিল্পকর্ম অনেক বেশি প্রাণবন্ত ও মৌলিক হয়ে ওঠে।

(3) শিক্ষা, সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চার উন্নতি: নবজাগরণের ফলে ইউরোপে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন আসে। এই সময় থেকে ধর্মকেন্দ্রিক শিক্ষার পরিবর্তে শুরু হয় মানবতাবাদী শিক্ষা। এরূপ শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যে ছিল ‘পূর্ণ মানুষ তৈরি’ (Development of all round Man)। অন্যদিকে রেনেসাঁ কালপর্বে মানবতাবাদী পণ্ডিতরা ল্যাটিন ভাষায় ব্যাকরণ, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি প্রকাশ করেন। এ ছাড়া শুরু হয়েছিল স্থানীয় ভাষায় সাহিত্যচর্চা। পাশাপাশি সাহিত্য ছাড়াও শিল্পের ক্ষেত্রেও অঞ্চল বা দেশভেদে স্বতন্ত্র ধারার সূচনা হয়েছিল। আবার এই সময় থেকে উন্নত হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চাও। কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, কেপলারের প্রদত্ত সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণা প্রথাগত চিন্তাভাবনায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে।

(4)  ধর্মসংস্কার: নবজাগরণ কালে চার্চের ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করা হলে, শুরু হয় প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন। এতে ধর্মভাবনার পুনর্মূল্যায়ন করা হয়, যার ফলে সমাজে নানা পরিবর্তন সাধিত হয়।

(5) রাজনীতিতে প্রভাব: নবজাগরণের দরুন রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বেশকিছু পরিবর্তন আসে। এর ফলে গণতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তি স্থাপিত হয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় মানবাধিকার ও জনগণের অংশগ্রহণের গুরুত্বও বৃদ্ধি পায়।

(6) অভিজাতদের রেনেসাঁ ও নগরকেন্দ্রিকতা: রেনেসাঁর সময় গ্রিক ও ল্যাটিন জ্ঞানভাণ্ডার কখনোই সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। এর আস্বাদ পেয়েছিলেন কেবল মুষ্টিমেয় অভিজাত শ্রেণির মানুষরাই। তাই ইউরোপীয় নবজাগরণকে অভিজাত শ্রেণির রেনেসাঁ (Aristrocratic Renaissance) বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে গবেষক হ্যালের মতে, নবজাগরণের ঢেউ নগরগুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল। বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে তা পৌঁছোয়নি। 

(7) পুঁজিবাদী শোষণ: আর এস লোপেজ, এ্যাস্টনি মালো-এর মতে, মানবতাবাদীদের চিন্তাধারায় সাধারণ মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। পুঁজিবাদী শোষণ আগের মতোই বর্তমান ছিল। সাহিত্য-সংস্কৃতির পুনরুদ্ধারে মগ্ন কবি-সাহিত্যিক-ধর্মগুরু কেউই জনগণের আর্থিক দুর্দশার অবসানের কথা ভাবেননি। এহেন অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল ‘নবজাগরণ’ ভাবাদর্শের বিরোধী।

মূল্যায়ন

নবজাগরণের কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল ঠিকই, তবে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, বস্তুতপক্ষে রেনেসাঁ যুগের পরিবর্তনসমূহ পরবর্তীকালে আধুনিক ইউরোপের ভিত্তি স্থাপনে সহায়ক হয়েছিল। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের এই পুনরুজ্জীবন ও উত্তরণ থেকেই জন্ম নিয়েছিল নতুন জগতকে জানা এবং আবিষ্কারের প্রচেষ্টা। পরবর্তীতে বহির্বিশ্বে যে ইউরোপীয় শক্তিসমূহের প্রতিপত্তির বিস্তার ঘটেছিল, তার নৈতিক সমর্থনের ক্ষেত্র ছিল রেনেসাঁর এই সময়কাল। বর্তমানে বিশ্বকে জানা ও চেনার যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটাও নবজাগরণের কালপর্ব থেকেই তৈরি হয়েছিল।

আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর

একাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের যে কোনো প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন। কোনো উত্তর না পেলে আমাদের কমেন্ট বক্সে জানান।

Leave a Comment