ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের অবদান আলোচনা করো
অথবা, কীভাবে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম আইনসংগত অধিকার লাভ করল
ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের অবদান
জন ওয়াইক্লিফের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জার্মানি তথা সমগ্র ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে যিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি হলেন মার্টিন লুথার (Martin Luther, ১৪৮৩- ১৫৪৬ খ্রি.)। ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় চরিত্র মার্টিন লুথার ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর জার্মানির স্যাক্সনি প্রদেশের ইসালিবেন গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জার্মানির এরফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভের পর তিনি উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। ইতিপূর্বে ১৫০৭ খ্রিস্টাব্দে লুথার খ্রিস্ট ধর্মের অগাস্টিয়ান সন্ন্যাসী সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
(1) আন্দোলনের সূচনা: ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে লুথার ক্যাথলিক ধর্মের কেন্দ্রস্থল ও পোপের অধিষ্ঠানক্ষেত্র রোম পরিদর্শনে যান। এখানে ক্যাথলিক চার্চ ও যাজকদের দুর্নীতি ও অনাচার সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়। পোপ ও যাজকদের অনৈতিক আচরণ এবং বাইবেলে বর্ণিত খ্রিস্ট ধর্মের মর্মবাণীর ভুল বা মিথ্যা ব্যাখ্যা সম্পর্কে লুথার জনগণকে সচেতন করার কাজ শুরু করেন। তাঁর এই আন্দোলন ধর্মসংস্কার আন্দোলন বা প্রতিবাদী ধর্মসংস্কার আন্দোলন (Protestant Movement) নামে পরিচিত হয়।
(2) ৯৫ দফা প্রতিবেদন: রোমান ক্যাথলিক মতে, মৃত্যুর পর মানুষ যাজকের আশীর্বাদে ছোটোখাটো পাপ থেকে মুক্তি পেতে পারে কিংবা সাময়িক যন্ত্রণা ভোগ করে সম্পূর্ণ পাপমুক্ত হতে পারে। যাজকের এই আশীর্বাদ লাভের জন্য সাধারণ মানুষকে অর্থের বিনিময়ে মার্জনাপত্র ক্রয় করতে হত, একে বলা হত Indulgence. ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির স্যাক্সনি প্রদেশে জোহান টেটজেল নাম একজন ডোমিনিকান যাজক পোপ দশম লিও স্বাক্ষরিত মুক্তিপত্র বিক্রি করতে আসেন। এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে মার্টিন লুথার ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে উইটেনবার্গ চার্চের প্রবেশদ্বারে ৯৫টি প্রশ্ন-সংবলিত একটি তালিকা ঝুলিয়ে দেন। এই তালিকাই ৯৫ দফা প্রতিবেদন নামে পরিচিত।
(3) Anti Theses প্রচার: লুথারের এই ৯৫টি প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে টেটজেল ১০৬টি প্রতিপ্রশ্ন (Anti Theses) ছাপিয়ে প্রচার করেন। ছাত্রসমাজ এসময় প্রতি প্রশ্নগুলিকে পুড়িয়ে লুথারের পাশে এসে দাঁড়ায়।
(4) মতাদর্শ এবং পুস্তিকা প্রচার: লুথার মনে করতেন, পোপতন্ত্র ঈশ্বরের সৃষ্টি নয় এবং প্রতিটি মানুষই নিজেই নিজের পুরোহিত। পোপতন্ত্রের মিথ্যাচারের প্রতিবাদে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে লুথার তিনটি প্রচার পুস্তিকা প্রকাশ করেন। যথা- Address to the Christian Nobility of the German Nation (বা An Appeal to the Christian Nobility of the German Nation), A Prelude Concerning the Babylonian Captivity of the Church এবং A Treatise on Christian Liberty (বা On the Freedom of a Christian), বলাবাহুল্য লুথারের এই পুস্তিকাগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনা জাগ্রত করে। লুথার তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন যে, ঈশ্বরের বাণীই ধর্মতত্ত্ব। তিনি বলেন, একজন খ্রিস্টান স্বাধীনভাবেই ধর্মপালন করতে পারেন। একজন যাজক চার্চের প্রশাসন বা শিক্ষাদানে অংশ নিতে পারেন। কিন্তু তাঁরা অন্যান্য মানুষের থেকে বেশি মর্যাদার অধিকারী হতে পারেন না। পাশাপাশি লুথার ক্যাথলিকদের সঙ্গে সম্পর্কিত সাতটি অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহের (Sacraments) সংখ্যা কমিয়ে তিনটি করেন। যথা- খ্রিস্ট ধর্মের আনুষ্ঠানিক দীক্ষা বা Baptism, • জিশুর শেষ ভোজনের স্মৃতি উপলক্ষ্যে পালনীয় একটি বিশেষ প্রতীকী অনুষ্ঠান বা Eucharist; যেখানে প্রভুর উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত রুটি ও মদ খাদ্য হিসেবে ভাগাভাগি করে গ্রহণ করতে হয় এবং Penance বা কোনও খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীকৃত পাপ যাজকদের কাছে স্বীকার এবং যাজক কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে উক্ত পাপীকে ক্ষমা প্রদর্শন।
(5) লুথারকে সমাজচ্যুত ঘোষণা ও ওয়ার্মস-এর ধর্মসভা: লুথারের বক্তব্য পোপের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। অতঃপর তাঁকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হলে লুথার ওয়ার্টবার্গ দুর্গে আত্মগোপন করেন। এমত পরিস্থিতিতে তাঁকে সমাজচ্যুত করা হয় (৩ জানুয়ারি, ১৫২১ খ্রিস্টাব্দ) কিছুদিনের মধ্যেই ওয়ার্মস-এর এক সভা (Diet of Worms) আহ্বান করা হয়। এই ধর্মসভার অনুশাসনের ভিত্তিতে মার্টিন লুথারকে ধর্মদ্রোহী এবং আইনবহির্ভূত ব্যক্তি (Outlaw) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
(6) রাজশক্তির সুদৃঢ়করণ: অবশ্য শেষপর্যন্ত ওয়ার্মসের ডিক্রি ব্যর্থ হয়েছিল। পাশাপাশি বাড়ছিল লুথারের মতবাদের জনপ্রিয়তা। ১৫২১ থেকে ৩১- এই এক দশকে স্যাক্সনি থেকে অন্যান্য জার্মান রাজ্যগুলিতে লুথারের মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে। জার্মানির স্ট্রাসবার্গ, উম, অগসবার্গ, হ্যামবার্গ, ব্রিমেন, নুরেমবার্গ ও ল্যুবেক শহরের বাসিন্দারা লুথার কথিত ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল। বেশকিছু জার্মান প্রদেশের শাসকও লুথারের মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন। এই সময় তিনি জার্মান ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেন। এ ছাড়া রাজশক্তির সমর্থন লাভের জন্য এসময় তিনি ঘোষণা করেন যে, পোপ বা যাজক নন, বরং রাজশক্তি ও তার অনুগামীরাই হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি।
(7) প্রোটেস্ট্যান্টদের উত্থান: ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে স্পিয়ারের দ্বিতীয় ধর্মসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্যাথলিকরা জার্মানবাসীদের লুথারের মতবাদকে পরিত্যাগ করার কথা বলেন। কিন্তু এর বিরুদ্ধে লুথারের অনুগামীরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। এরপর থেকে যারা ক্যাথলিক চার্চ পরিত্যাগ করে চলে যান, তারাই পরিচিত হতে থাকেন প্রোটেস্ট্যান্ট (Protestant) নামে।
(8) গৃহযুদ্ধ: পবিত্র রোমান সম্রাট পঞ্চম চার্লস (Charles V) অতঃপর লুথারবাদকে ধ্বংস করতে প্রোটেস্ট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। প্রোটেস্ট্যান্টপন্থীরাও সম্মিলিত হয়ে গঠন করেন Schmalkaldic League | জার্মানিতে ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ চলে। এই পরিস্থিতিতে ১৫৪৬ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন লুথারের মৃত্যু হয়। অবশেষে ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে অগসবার্গের সন্ধি (Peace of Augsburg) দ্বারা উভয়পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয় এবং প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ তথা ধর্ম আইনসংগত স্বীকৃতি লাভ করে।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর