ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলি কী ছিল
পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামন্ততন্ত্রের কিছু আঞ্চলিক বৈচিত্র্য থাকলেও এই ব্যবস্থার কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়।
সামন্ততন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ
(1) কেন্দ্রীয় দুর্বলতা: ৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ভার্দুনের বণ্টনের পর কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হয়ে পড়লে বিভিন্ন বহিরাগত জাতির আক্রমণে ইউরোপের শক্তিশালী সাম্রাজ্যের কাঠামো ভেঙে পড়ে। একে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক শাসকরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় শাসকও আঞ্চলিক সামন্তপ্রভুদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
(2) স্থবির অর্থনীতি: ঐতিহাসিক অঁরি পিরেন (Henry Pirenne) দেখিয়েছেন যে, মধ্যযুগে ইসলামীয় আগ্রাসনের ফলস্বরূপ ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের পতন ও তার থেকে নগরের অবক্ষয় ঘটলে গ্রামগুলি সমৃদ্ধ হয়। গ্রামগুলি নিজেদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী উৎপাদন করতে শুরু করলে জন্ম হয় স্থবির অর্থনীতির।
(3) কৃষির অনগ্রসরতা: প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মরিস ডবের মতে, আলোচ্য কালপর্বে সামন্তপ্রভুরা উন্নতমানের কৃষি প্রযুক্তি ও অর্থকরী ফসল চাষে উৎসাহী না হলে উদ্বৃত্ত কৃষিজ উৎপাদন ব্যাহত হয়।
(4) জমির গুরুত্ব: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামন্তপ্রভুদের মর্যাদা ও শক্তির যাবতীয় আধার ছিল জমি। যে প্রভুর অধীনে যত বেশি সংখ্যক জমি থাকত, সে তত বেশি সংখ্যক ভ্যাসাল ও ভূমিদাস নিয়োগ করতে পারত। মধ্যযুগীয় ইউরোপে এভাবেই জমিকে কেন্দ্র করে উৎপাদন ব্যবস্থা ও আর্থসামাজিক কাঠামোর ভিত্তি রচিত হয়, যা ছিল সামন্ততন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(5) ম্যানর প্রথা: বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদের জনক কার্ল মার্কস মনে করেন যে, ম্যানর ব্যবস্থা হল সামন্ততন্ত্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। সামন্ততন্ত্রের যুগে যে জমিকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ম্যানর প্রথা। এই ব্যবস্থায় ভূম্যধিকারী তাঁর ম্যানরের অন্তর্গত সকল ভূমিদাস কৃষকের উপর শাসন ও বিচার সংক্রান্ত যাবতীয় অধিকার ভোগ করতেন। এর বিনিময়ে ভূমিদাসরা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা ও জীবনধারণের অধিকার লাভ করত। শুধু তাই নয়, সামন্তপ্রভু তাঁর ম্যানর হাউসকে কেন্দ্র করে ভূমিদাস ও মুক্ত কৃষকদের নিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন।
(6) শিক্ষিত যোদ্ধা শ্রেণি: রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে সামন্তযুগে নাইট নামে পরিচিত যোদ্ধা শ্রেণির অস্তিত্ব অনিবার্য হয়ে পড়ে। সুশিক্ষিত এই যোদ্ধা শ্রেণি শিভালরি আদর্শ মেনে জীবন অতিবাহিত করত।
(7) উর্ধ্বতনের কাছে আনুগত্য: ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অধস্তনের আনুগত্য প্রদর্শন হল সামন্ততন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। সামন্তযুগে ঊর্ধ্বতন প্রভু কমানডেশন (Commendation) নামক একটি অনুষ্ঠানের দ্বারা তাঁর অধস্তনকে ফিফ বা জমি প্রদান করতেন। এই সময় অধস্তন কর্তৃপক্ষ তাঁর ঊর্ধ্বতনকে সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিত হোমেজ (Homage) নামক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এ ছাড়া অধীনস্থ কৃষক শ্রেণির অস্তিত্ব, শোষণমূলক করব্যবস্থা ইত্যাদিও ইউরোপের সামন্ততন্ত্রকে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করতে সহায়তা করেছিল।
আরও পড়ুন – জাতি ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন উত্তর