আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হিসেবে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির ভূমিকা বিশ্লেষণ করো
অথবা, ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা ব্যাখ্যা করো।
অথবা, আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তাবিদ হিসেবে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির ভূমিকা
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি (Niccolo di Bernardo dei Machiavelli) ছিলেন ইটালির একজন প্রখ্যাত দার্শনিক, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক এবং কূটনীতিবিদ। নবজাগরণের পীঠস্থান ইটালির ফ্লোরেন্স শহরের এক অভিজাত পরিবারে ম্যাকিয়াভেলি জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি ফ্লোরেন্সের কূটনৈতিক ও সরকারি কাজ দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন এবং সেখানকার প্রজাতন্ত্রের শেষ প্রধান সোদেরিনির মুখ্য পরামর্শদাতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
রাষ্ট্রচিন্তার উৎস
সমকালীন ইটালির নগররাষ্ট্রগুলির মধ্যে অবিরত দ্বন্দ্ব, সামন্তব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা, অন্যদিকে নবজাগরণের উদ্যমশীলতা এবং গ্রিক ঐতিহাসিক প্লেটো, অ্যারিস্টটল, পলিবিয়াস কিংবা রোমান দার্শনিক সিসেরোর রাষ্ট্রচিন্তা ও ভাবাদর্শ ম্যাকিয়াভেলিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
ম্যাকিয়াভেলি রচিত গ্রন্থ
সাহিত্যিক হিসেবে ম্যাকিয়াভেলি বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করলেও, তাঁর রাজনৈতিক ধারণা সম্পর্কে মূলত দুটি গ্রন্থ থেকে জানা যায়-
- দ্য প্রিন্স (The Prince): এই গ্রন্থের বিষয় নবীন রাজতন্ত্র, যেখানে শাসকের শক্তি, স্বৈরাচার ও কঠোর নিয়ন্ত্রণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
- দ্য ডিসাকার্সেস (The Discourses): এই গ্রন্থে প্রজাতান্ত্রিক সরকারকে কেন্দ্র করে আলোচনা করা হয়েছে, যেখানে প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে সরকারের সঙ্গে নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য ও সহযোগিতার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।
আলোচনা পদ্ধতি
ম্যাকিয়াভেলি তাঁর আলোচনায় মূলত কঠোর বাস্তববোধকেই কাজে লাগিয়েছেন। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রতত্ত্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি তথ্য সংগ্রহ, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণের মতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন। পাশাপাশি ইতিহাসের সাহায্যগ্রহণ ছিল ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রদর্শন গড়ে তোলার এক উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি। এ ছাড়া তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বে অ্যারিস্টটলের আরোহমূলক পদ্ধতিরও (বিশেষ থেকে সাধারণে পৌঁছোবার পরিকল্পনা) প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়।
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
- স্বতন্ত্র রাষ্ট্রভাবনা: প্রচলিত রাজনৈতিক সীমানায় আবদ্ধ না থেকে তিনি এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্রভাবনা উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রের ক্ষমতা, মর্যাদা ও স্থায়িত্ব রক্ষার পথ উদ্ভাবন করা।
- আধুনিকতা: ম্যাকিয়াভেলি মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণার বেড়াজাল ছিন্ন করে আধুনিক যুক্তিবাদী, বাস্তববাদী ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন।
- ধর্মনিরপেক্ষতা: তিনি ধর্ম থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করেন ও বলেন যে, রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটলে রাজনীতির নিজস্বতা ব্যাহত হবে।
- নৈতিকতা বা মূল্যবোধ: ম্যাকিয়াভেলির মতে, ব্যক্তির মূল্যবোধ ও রাষ্ট্রের মূল্যবোধ এক হতে পারে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনে শাসক শঠতা, বিশ্বাসঘাতকতার আশ্রয় নিলে তা অনৈতিক নয়।
- প্রয়োজনভিত্তিক রাষ্ট্রনীতি: রাজতন্ত্রের ভিত সুদৃঢ় করার স্বার্থে ম্যাকিয়াভেলি বাহুবল (Good Arms), ভালো আইন (Good Law), ভালো দৃষ্টান্ত (Good Examples)-এর প্রয়োজনভিত্তিক প্রয়োগ করার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয়সমূহ
(i) মানবপ্রকৃতি: ম্যাকিয়াভেলি তাঁর চিন্তাধারার কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষকে স্থান দিয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ভিত্তিতে মানবচরিত্রকে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর মতে, মানুষ অকৃতজ্ঞ, প্রতারক, কাপুরুষ ন্যায়নীতিবোধহীন ও অর্থলিঙ্গু। এর ফলে মানুষের মধ্যে ক্ষমতা ও অর্থলাভের চাহিদা বাড়তে থাকে। এইজন্য মানুষে মানুষে সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং রাষ্ট্রের মধ্যে বিশৃঙ্খলা লক্ষ করা যায়।
(ii) রাষ্ট্র ও তার বৈশিষ্ট্য: ম্যাকিয়াভেলির তত্ত্ব থেকে প্রাপ্ত রাষ্ট্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল- রাষ্ট্রকে চার্চ ও ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কহীন সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে। মানুষ মূলত নিজ স্বার্থসিদ্ধি ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে স্বাগত জানায়। রাষ্ট্র সবসময় নিজ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থাকে। সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা প্রদানের মধ্য দিয়ে নিজ জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করা। ম্যাকিয়াভেলির মতে, জনগণ যে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজে অংশ নিতে পারে, সেই রাষ্ট্র শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র।
(iii) রাষ্ট্রের শ্রেণিবিভাগ: ম্যাকিয়াভেলি অ্যারিস্টটলের অনুকরণে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সরকারকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন, যথা- রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্র। তিনি মনে করতেন যে, একমাত্র সবল রাজতন্ত্রই রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে এবং জাতির গৌরব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে পারে।
(iv) রাজতন্ত্রের স্বরূপ নির্ণয়: ম্যাকিয়াভেলি তাঁর The Prince গ্রন্থে রাজতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনায় বলেছেন, রাজার প্রধান দায়িত্ব রাজ্যকে সুরক্ষিত করা। এ ছাড়াও রাজার কাজ হবে যে-কোনোভাবে রাজ্যশাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করা। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য রাজাকে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হতে হবে। রাজাকে তাঁর কাজকর্মে সাহস, দৃঢ়তা ও বীরত্ব দেখাতে হবে। পাশাপাশি যে-কোনো পরিস্থিতিতে রাজা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এবং বিরোধীপক্ষকে বলপ্রয়োগের দ্বারা দমন করবেন। এককথায় রাষ্ট্রের গৌরব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য রাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা ম্যাকিয়াভেলি উল্লেখ করেন।
(v) প্রজাতান্ত্রর স্বরূপ নির্ণয়: ম্যাকিয়াভেলি তাঁর The Discourses গ্রন্থে আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি এই গ্রন্থে রাজতন্ত্র অপেক্ষা প্রজাতন্ত্র অর্থাৎ, মানুষের স্বার্থ ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে মুক্ত রাষ্ট্র (Free State) বলে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, সবধরনের শাসনব্যবস্থা থেকে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই শ্রেষ্ঠ। তিনি দুই ধরনের প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা বলেছেন- ① অভিজাততান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং জনগণের প্রজাতন্ত্র। তিনি সর্বসাধারণের জন্য জনগণের প্রজাতন্ত্রকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন।
(vi) ক্ষমতাতত্ত্ব: ম্যাকিয়াভেলির মতে, রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র উভয়ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রাথমিক শর্ত হল ক্ষমতা দখল। জনগণকে শাসন করার মাধ্যম হল ক্ষমতা। ক্ষমতা দখলের পদ্ধতি, তা বজায় রাখা, বা কী ধরনের ভ্রান্তনীতির দরুন ক্ষমতার ভিত্তি দুর্বল হয় -এসব কিছুই ম্যাকিয়াভেলি তাঁর তত্ত্বে আলোচনা করেছেন। ল্যাস্কি (Laski)-র মতে, ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রতত্ত্ব হল Grammar of Power বা ক্ষমতার ব্যাকরণ। ক্ষমতা অর্জন ও তা ধরে রাখার পদ্ধতি নিয়ে এত গভীর বিশ্লেষণের জন্য সম্ভবত ম্যাকিয়াভেলিকে রাজনীতির ক্ষমতাতত্ত্বের প্রথম ও সার্থক প্রবক্তা বলা হয়।
মূল্যায়ন
ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা পরস্পরবিরোধী অভিমত হিসেবে যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে। এ ছাড়াও তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্বের ত্রুটি হিসেবে মানুষের সদ্গুণাবলি উপেক্ষা, খণ্ডিত জাতীয়তাবোধ, বলপ্রয়োগকে গুরুত্ব দান, অসমাপ্ত তথ্য, যুগবিরোধী চিন্তা, ত্রুটিপূর্ণ ক্রমবিন্যাস প্রভৃতি বিষয়ের কথা বলা হয়ে থাকে। তবে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও, ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তা ব্যক্তির নৈতিকতা ও রাষ্ট্রের নৈতিকতার পার্থক্যকরণ, ক্ষমতা সংক্রান্ত তত্ত্ব, বুর্জোয়া শ্রেণির গুরুত্ব উপলব্ধি, অভিজ্ঞতার উপর গুরুত্ব আরোপ প্রভৃতি দিক থেকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
সর্বোপরি বলা যায়, ম্যাকিয়াভেলির চিন্তাধারায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান আধুনিক রূপলাভ করেছিল। তাই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পথিকৃৎ হিসেবে ম্যাকিয়াভেলির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর