অ্যারিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাটি বিশ্লেষণ করো
অ্যারিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্র/ সর্বোত্তম রাষ্ট্রের ধারণা
The Politics গ্রন্থে অ্যারিস্টটল আদর্শ রাষ্ট্র বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনও বক্তব্য পেশ করেছেন কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অ্যারিস্টটল তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রের যে ধারণাটির নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে রাষ্ট্রীয় জীবনের কতগুলি শর্তের উল্লেখ মেলে।
আদর্শ রাষ্ট্রের রূপ
মানুষের এক সুন্দর মঙ্গলময় জীবন ও সুখ নির্ভর করে আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর- এই ছিল অ্যারিস্টটলের বিশ্বাস। তাঁর মতে, আদর্শ রাষ্ট্র হল এমন এক রাষ্ট্র যেখানে আদর্শ গুণবিশিষ্ট মানুষের হাতে শাসনক্ষমতা থাকবে। প্রকৃতপক্ষে অ্যারিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাটি সদগুণের উপর প্রতিষ্ঠিত।
(a) চরম রাজতন্ত্র: অ্যারিস্টটল মনে করেন যে, যখন কোনও অসাধারণ সদগুণসম্পন্ন মানুষের মধ্যে ঈশ্বরস্বরূপ (God among men) ব্যক্তি পরম কল্যাণের লক্ষ্যে সকলকে পরিচালিত করেন, তখন উক্ত ব্যক্তির হাতে প্রতিষ্ঠিত চরম রাজতন্ত্রই আদর্শ রাষ্ট্রের পরিচায়ক। যদিও বাস্তবে এরূপ অতিমানবিক ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া খুব একটা সহজ বিষয় নয়।
(b) বিশুদ্ধ অভিজাততন্ত্র: অ্যারিস্টটল বিশুদ্ধ অভিজাততন্ত্রের কথা উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে, এইরূপ অভিজাততন্ত্র সততা, আদর্শ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু তাই নয়, এখানে রাষ্ট্রটি কাঠামোগত দিক থেকে হবে গণতান্ত্রিক কিন্তু চারিত্রিক দিক থেকে অভিজাততান্ত্রিক। তবে অ্যারিস্টটল অভিজাততান্ত্রিক শাসনেও জনগণের স্বার্থ কীভাবে সুরক্ষিত রাখা যায় সে ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
(c) সুবর্ণ মধ্যক ও পলিটি: অ্যারিস্টটল বলেন যে, Golden mean (সুবর্ণ মধ্যক) এই সদ্গুণটি চরম হঠকারিতা ও চরম ভীরুতার এক মধ্যবর্তী পর্যায়ে অবস্থিত। তাই যে রাষ্ট্র এই দুই চরম অবস্থাকে বর্জন করে, এদের মধ্যবর্তী সৎ সাহস ও নৈতিকতার আদর্শ বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়- সেটিই আদর্শ রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে পলিটি অর্থাৎ মিশ্র শাসনব্যবস্থাই তাঁর কাছে আদর্শ রাষ্ট্রের পরিচায়ক।
আদর্শ রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য/শর্তসমূহ
(a) সীমিত জনসংখ্যা: বিশিষ্ট রাষ্ট্রচিন্তাবিদ অ্যারিস্টটলের মতে, আদর্শ রাষ্ট্রের জনসংখ্যা মাঝারি ধরনের হওয়াই ভালো। অধিক জনসংখ্যাবিশিষ্ট রাষ্ট্রই যে শ্রেষ্ঠ হবে এমনটা নয়। আদর্শ রাষ্ট্রের জনসংখ্যা এমন হতে হবে যাতে তারা আলাপ-আলোচনা করে প্রকৃত গুণী ব্যক্তিকে শাসক হিসেবে নিযুক্ত করতে এবং রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারেন।
(b) সাহসী ও বুদ্ধিমান জনগণ: জনগণের গুণাবলিকে আদর্শ রাষ্ট্রের অপর এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে অ্যারিস্টটল মতপ্রকাশ করেছেন। আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে যাতে ইউরোপীয়দের ন্যায় তেজস্বিতা ও সাহস এবং এশিয়াবাসীদের মতো বৌদ্ধিক চেতনা- এই উভয় গুণের বিকাশ ঘটে তার জন্য আদর্শ রাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাগণ বিশেষ দৃষ্টি রাখবেন।
(c) মাঝারি আকারের রাষ্ট্র: মাঝারি বা সীমিত আয়তনের ভূখণ্ড আদর্শ রাষ্ট্রের অন্যতম শর্ত। রাষ্ট্র বৃহৎ আকারের হলে তা সুশাসন করা যেমন অসম্ভব, তেমনই ক্ষুদ্র হলেও রাষ্ট্র স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে না। তাই নিরাপত্তা, ব্যাবসাবাণিজ্য, পরিমিত জীবনযাপন-সহ নানান দিকের বিচারে রাষ্ট্রের আকার মাঝারি বা সীমিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
(d) নাগরিকতা: রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে অ্যারিস্টটল সেই সকল নাগরিকদের বেছে নিয়েছেন যাঁরা রাষ্ট্রের কার্যকলাপে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। আদর্শ রাষ্ট্রের প্রধান সম্পদই হল আদর্শ নাগরিক। কারা নাগরিক এবং কারা নাগরিক নয়- এই বিষয়টির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অ্যারিস্টটল বলেছেন যে, শিশু, বৃদ্ধ, মহিলারা নাগরিক বলে বিবেচিত নন। এমনকি, কৃষক ও কারিগরদের কোনও নাগরিক অধিকার থাকবে না। তাঁর মতে, ন্যায় প্রশাসনে অংশগ্রহণকারী প্রশাসনিক পদাধিকারী ব্যক্তিই হলেন নাগরিক।
(e) আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা: এক সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা অ্যারিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রের অপর গুরুত্বপূর্ণ শর্ত বলে বিবেচিত হয়।
(f) সুদৃঢ় প্রশাসনিক কাঠামো: অ্যারিস্টটলের মতে, আদর্শ রাষ্ট্রে একটি সুদৃঢ় প্রশাসনিক কাঠামো থাকবে। এক্ষেত্রে তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ করেছেন, যথা- জনপ্রিয় আইনসভা, ম্যাজিস্ট্রেট সংস্থা ও বিচার বিভাগ।
আদর্শ রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা
এক আদর্শ ও ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র গঠনের প্রধান পন্থাই হল আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন- একথা অ্যারিস্টটল মনে করেন। আদর্শ শিক্ষাই শাসককে পরম মঙ্গল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত করতে, নাগরিককে সুপথে পরিচালনা করতে এবং সর্বোপরি এক সুখময়, কল্যাণকর জীবনযাপনে সাহায্য করে। অ্যারিস্টটল তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায়- (a) জন্মের পর প্রথম ৫ বছর ও তারপর, (b) ৭ থেকে ১৪ বছর ও (c) ১৪ থেকে ২১ বছর বয়সিদের জন্য পৃথক পাঠক্রমের বর্ণনা দিয়েছেন।
আদর্শ রাষ্ট্রের সমালোচনা
(a) কাল্পনিক ধারণা: অ্যারিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা অনেকাংশেই কাল্পনিক। তিনি আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের সুশিক্ষিত করার জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের কথা বলেছেন, তা বাস্তবায়িত করা খুবই কঠিন।
(b) মাঝারি জনসংখ্যার রাষ্ট্র: অ্যারিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্র হল মাঝারি জনসংখ্যাবিশিষ্ট রাষ্ট্র। কিন্তু বর্তমানে অধিক জনসংখ্যাবিশিষ্ট গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই লক্ষ করা যায়। আজকের দিনে অধিকাংশ রাষ্ট্রই জাতীয় রাষ্ট্র। তাই অ্যারিস্টটলের রাষ্ট্রচিন্তায় আধুনিক রাষ্ট্রের জনসংখ্যা বিষয়ক ধারণা অনুপস্থিত বলে সমালোচকগণ মনে করেন।
(c) অসম সমাজব্যবস্থা: আদর্শ রাষ্ট্রে অসম সমাজব্যবস্থার কল্পনা করেছেন অ্যারিস্টটল। তিনি সমাজের সমস্ত শ্রেণির মানুষকে নাগরিক অধিকার প্রদানের পক্ষপাতী ছিলেন না। শুধুমাত্র পুরোহিত, উপদেষ্টা, বিচারক ও যোদ্ধা শ্রেণিকে নাগরিক অধিকার প্রদানের পক্ষপাতী ছিলেন অ্যারিস্টটল।
(d) ক্রীতদাস প্রথাকে সমর্থন: অ্যারিস্টটল এক ন্যায়নির্ভর আদর্শ রাষ্ট্রের কথা বললেও ক্রীতদাস প্রথার ন্যায় নির্মম প্রথাকেও সমর্থন করেছেন- এই বিষয়টিও যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছে।
বস্তুতপক্ষে, আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের তত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও তিনি এমন কিছু বক্তব্য উপস্থাপিত করেছিলেন যেগুলি সর্বকালের ব্যবহারের জন্য উপযোগী- রাষ্ট্রচিন্তার জগতে যা বিশেষভাবে সমাদৃত।
আরও পড়ুন – রাষ্ট্রের প্রকৃতি প্রশ্ন উত্তর